জনগণতন্ত্রী এবং নাগরিকতন্ত্র, বহুত্ববাদে হারিয়ে যাবে না ধর্মনিরপেক্ষতা!
সৌরভ গাঙ্গুঁলী

জনগণতন্ত্রী এবং নাগরিকতন্ত্র, বহুত্ববাদে হারিয়ে যাবে না ধর্মনিরপেক্ষতা!

সৌরভ গাঙ্গুঁলী: আইনের ছাত্র হিসাবে আমরা যখন সংবিধান পাঠ করি তখন দুটি শব্দ প্রথমেই আমাদের মস্তিষ্কে ক্ষতের সৃষ্টি করে, সেই শব্দ দুটির একটি হচ্ছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ এবং আরেকটি হচ্ছে ‘প্রজাতন্ত্র’। এর মূল কারণ হচ্ছে, উভয় শব্দ দুটিতেই উপস্থিত এই ‘প্রজা’ শব্দটি।

১৯১৭ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে যে সকল আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে আত্মনিয়োগ এবং বীর শহীদদেরকে প্রাণোৎসর্গ করতে উদ্ধুদ্ধ করেছে, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জনের পর আমরা সেই বীর জনগণের আত্মনিয়োগের ফলাফল স্বরুপ তাদেরকে প্রজা হিসাবেই সংবিধানে চিহ্নিত করেছি।

বর্তমানে বলবৎ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে, প্রস্তাবনা অংশের শুরুতে বলা হয়েছে যে, ‘আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া [জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের] মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করিয়াছি’।

এরপর এই সংবিধানের ১১টি ভাগের প্রথম ভাগ অর্থাৎ প্রজাতন্ত্র অংশে ১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন, সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র, যাহা গণপ্রজাতন্ত্রী নামে পরিচিত হইবে’। সংবিধানের বেশ কিছু জায়গায় এই শব্দ দুটির ব্যবহার করা হয়েছে।

সংবিধানের প্রাধান্য অংশে ৭(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’। এখন সকলের মনে ভাবনা জাগতে পারে, যে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ সেই রাষ্ট্র কিভাবে ওই রাষ্ট্রের জনগণকে প্রজা হিসাবে আখ্যা দিতে পারে!

যদিও এই সংবিধানটি সে সময় গ্রহণ করার পিছনে সকল জনগণের মেন্ডেট ছিল তবুও এই প্রজা শব্দটি বর্তমান সময়ে এসে আমাদেরকে অনেক ব্যথিত করে। আসলে যখন এই সংবিধানটি প্রণয়ন করা হয়েছিল তখনই এই প্রজা শব্দটিকে প্রত্যাখ্যান করা উচিত ছিলো। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত আজ স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা সাংবিধানিক ভাবে প্রজা হিসাবেই চিহ্নিত হয়ে আসছি।

গণপ্রজাতন্ত্রী এবং প্রজাতন্ত্র শব্দ দুইটির ইংরেজি অনুবাদ যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে দেখব যে, গণপ্রজাতন্ত্রী শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘পিপলস্ রিপাবলিক’ এবং প্রজাতন্ত্র শব্দের অর্থ ‘রিপাবলিক’। এখানে ‘পিপলস্ আর ‘রিপাবলিক’ দুটি শব্দ দিয়েই জনগণ কে বুঝানো হয়েছে।

আরও পড়ুনসারাদেশে ‘হাইকোর্ট’ প্রবর্তন ও অধস্তন আদালতকে ‘স্থানীয় আদালত’ নামকরণের সুপারিশ

‘রিপাবলিক’ শব্দটি দিয়ে যদি জনগণকেই বুঝানো হয়ে থাকে, তাহলে বাংলা অনুবাদে জনগণের জায়গায় অর্থাৎ জনতন্ত্র শব্দটি ব্যবহার না করে প্রজাতন্ত্র শব্দটি কেন ব্যবহার করা হয়েছে?

জুলাই-আগষ্ট গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশকে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সংবিধান সংস্কার কমিশন গত ১৫ জনুয়ারী, বুধবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে বেশকিছু প্রস্তাবনা দিয়েছে, যেখানে দেশটির সাংবিধানিক নাম ও রাষ্ট্রীয় মূলনীতিসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার সুপারিশ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের বর্তমান সাংবিধানিক নামে থাকা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ ও ‘প্রজাতন্ত্র ‘ শব্দগুলো বাদ দিয়ে সেখানে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ ও ‘নাগরিকতন্ত্র’ ব্যবহার করার সুপারিশ করেছে কমিশন।

আমার কাছে এই শব্দ দুটি খুবই চমকপ্রদ, মানসম্মত এবং যথাযথ বলে বিবেচিত হয়েছে৷ কারণ বাংলা অর্থে আমরা যেটিকে প্রজা বলছি সেটি আসলে ইংরেজি অর্থের মানসম্মত বাংলা নয়। শুরুতেই আমাদের উচিত ছিলো এই প্রজা শব্দটিকে বাদ দিয়ে সেই শব্দের জায়গায় জনগণ অথবা নাগরিক শব্দটি গ্রহণ করা। সংবিধান সংস্কার কমিশনের হাত ধরে এই শব্দ দুটি পরিবর্তনের প্রস্তাবকে আমি শতভাগ সমর্থন করি।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনায় আরও বেশ কিছু বিষয় রয়েছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে, সংবিধানের মূলনীতির পরিবর্তন। বর্তমান সংবিধানের চারটি মূলনীতির তিনটিই বাদ দিয়ে, একটি সহ নতুন আরও চারটি, অর্থাৎ মোট পাঁচটি মূলনীতিকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব।

বর্তমান সংবিধানের মূলনীতি হচ্ছে চারটি- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র। সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র।

অনেকেই দাবি করছেন যে, ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দিলে হয়ত বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হবে। এই রাষ্ট্রে সকল ধর্ম চার্চার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ব্যহত হবে। তবে আমি এই দাবিকে সমর্থন করি না। আমরা সরাসরি ধর্মনিরপেক্ষতা তত্ত্বকে না খুঁজে বহুত্ববাদের তত্ত্বে ধর্মনিরপেক্ষতাকে খুঁজে পেতে পারি৷ আমরা যদি ধর্মনিরপেক্ষতার উপাদান আর বহুত্ববাদের উপাদান সমূহ বিশ্লেষণ করি তাহলে আমরা বহুত্ববাদ তত্ত্বের ভিতরেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে খুঁজে পাব।

ধর্মনিরপেক্ষতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি উপাদান হচ্ছে,

১। একই ধর্মের অন্তর্গত মানুষ একজন আরেক জনের ধর্ম পালনে বাধার সৃষ্টি করতে পারবে না। উদাহরণস্বরুপ : ইসলাম ধর্মে শিয়া ও সুন্নি নামে দুটি প্রধান শাখা রয়েছে। এখানে ধর্মনিরপেক্ষতা হলো- শিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারীগণ সুন্নি সম্প্রদায় অথবা সুন্নি সম্প্রদায়ের অনুসারীগণ শিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারীগণের ধর্ম পালনে কোনরুপ বাধার সৃষ্টি করতে পারবে না। আবার সনাতন ধর্ম অনুযায়ী, ধর্মপালনের ক্ষেত্রে অনেক মতবাদ লক্ষ্য করা যায়। এখানে ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে- এক মতবাদের মানুষ আরেক মতবাদের মানুষের ধর্মপালনে কোনরুপ বাধার সৃষ্টি করতে পারবে না।

২। এক ধর্মের অনুসারীগণ আরেকটি ভিন্ন ধর্মের অনুসারীগণের ধর্মপালনের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করতে পারবে না। উদাহরণস্বরুপ: মুসলিম ধর্মালম্বীগণ হিন্দুধর্মাবলম্বীদের উপরে অথবা হিন্দুধর্মালম্বীগণ মুসলিম ধর্মালম্বীদের ধর্মপালনের ক্ষেত্রে কোনরুপ বাধার সৃষ্টি করতে পারবে না।

৩। ধর্মীয় স্বাধীনতা, সুবিচার, ও ধর্মীয় সম মর্যাদার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে।

মোটামুটি এই তিনটি গ্রহণযোগ্য কথাই হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আর বহুত্ববাদ তত্ত্বের উপাদান অনুযায়ী, বহুত্ববাদ মূলত সমাজে বিভিন্ন গোষ্ঠী, বিভিন্ন ধর্ম, মতামত, সংস্কৃতি, ও বিশ্বাসের সহাবস্থানের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে। অর্থাৎ বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি, জাতি, ভাষা, এবং মতাদর্শের পার্থক্যকে স্বীকার করা এবং তার প্রতি সম্মান জানানো। যারা বহুত্ববাদকে স্বীকার করবে তারা অবশ্যই বিভিন্ন ধর্মের প্রতি সম্মান রাখবে এবং ধর্মপালনের স্বাধীনতাকে খর্ব ও বাধাপ্রদান করবে না।

এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে, যথাযথ ভূমিকা পালনের মাধ্যমে সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে নিরপেক্ষ ভাবে সকল ধর্ম পালনের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করা। তাই প্রাথমিক ভাবে বলা যেতে পারে যে, বহুত্ববাদের অন্তর্ভুক্তি, ধর্মনিরপেক্ষতাকে হারিয়ে যেতে দিবে না । আমাদের প্রাণের এই মাতৃভূমি সর্বদাই ধর্মনিরপেক্ষ থাকবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ; ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।