সংস্কার আসুক আদালতের নাম ও বিচারকের পদবি ব্যবহারের প্রচলিত  রীতিতে
মতিউর রহমান; জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট

ডিসি পদের নাম ‘ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট’ নয়, হতে পারে ‘জেলা সমন্বয়ক’

মতিউর রহমান: বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম হতে জানা যাচ্ছে যে, জেলা প্রশাসক বা ডিসি পদের নাম পরিবর্তন করে পদটির মূল নাম ‘ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট’ করার জন্য প্রস্তাব করা হতে পারে (সূত্র: যুগান্তর)। Cambridge ডিকশনারি অনুযায়ী একজন বিচারক যিনি ক্ষুদ্র অপরাধের বিচার করেন তাকেই ম্যাজিস্ট্রেট বলে। আমাদের দেশের প্রচলিত আইনও সেটিই বলে।

২০০৭ সালের পূর্বে ছোট অপরাধের বিচারের এখতিয়ার ডিসিদের থাকলেও বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পর সৃজিত পদ চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট/ চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট সেই সকল দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে।

ডিসি পদটি মূলত ব্রিটিশ আমলে রাজস্ব সংগ্রহের নিমিত্ত District Collector হিসেবে চালু হলেও পরবর্তীতে দায়িত্ব পালনের প্রয়োজনে ছোট অপরাধের বিচারিক ক্ষমতা অর্পণ করে District Magistrate নামে আরেকটি পদ দেয়া হয়।

পাকিস্তান আমলে জেলার উন্নয়ন কর্মসমূহের দেখাশোনার নিমিত্ত Deputy Commissioner হিসেবেও দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। একই কর্মকর্তা ৩টি পদ ধারণ করে দায়িত্ব পালন করতেন।

বর্তমান বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জেলা প্রশাসক শব্দটির প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। বিশেষত সরকারি দপ্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলকভাবে গৃহীত হওয়ার কারণে কেবলমাত্র ডেপুটি কমিশনারের কাজের ক্ষেত্রেই নয়, ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের সামগ্রিক কাজের ক্ষেত্রেও একক বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ‘জেলা প্রশাসক’ এর ব্যবহার প্রায়োগিক ক্ষেত্রে প্রচলিত (সূত্র: উইকিপিডিয়া)।

২০০৭ সালে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের প্রায় সকল দায়িত্ব চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট/চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট অর্পিত হলেও, প্রচলিত ‘ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট’ পদবি পূর্বের ন্যায় ডিসিদেরই রয়ে গেছে।

আরও পড়ুন: অধস্তন আদালতের পরিবর্তে “স্থানীয় আদালত” নয়, হতে পারে “জেলা আদালত বা জেলা বিচার বিভাগ”

ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক কোন এখতিয়ার নাই। তবে লাইসেন্স প্রদান/বাতিল, বন্ড গ্রহণ, আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ও সুরতহাল সহ কিছু নির্বাহী প্রকৃতির দায়িত্ব অর্পণ করে, ২০০৭ সালে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নামীয় ম্যাজিস্ট্রেসির এক প্রকার পদ চালু করা হয়।

উচ্চ আদালত কর্তৃক বাতিল ঘোষিত এবং উচ্চ আদালতে বিচারাধীন মোবাইল কোর্ট আইনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের সীমিত ক্ষেত্রে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সাজা দেয়ার ক্ষমতা আছে। তবে সেটি সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যালোচনা অন্তে যে বিচার কাজ সেই প্রকৃত বিচারিক কাজ নয়। উক্ত প্রকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রধান হিসেবে ডিসিদের দায়িত্ব দেওয়ায় পূর্বের প্রচলিত নাম/পদবি বাতিল করা হয় নি।

ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে ম্যাজিস্ট্রেসির মূল কাজ বিচারিক এখতিয়ার না থাকা সত্ত্বেও ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেট’ হিসেবে পূর্বের এই নাম/পদবি বহাল থাকায় জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। এমনকি P.R.B সহ বিভিন্ন পুরাতন আইনে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শব্দটি বহাল থাকায় বিভ্রান্তির উদ্রেক করে যা চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের বিভিন্ন দায়িত্ব পালনে অসুবিধার সৃষ্টি করে।

এই অবস্থায় যদি বিচারিক কার্যক্রম ও ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল দায়িত্ব না থাকা সত্ত্বেও ডিসিদের মূল নাম জেলা ম্যাজিস্ট্রেট করা হয় তাহলে জনমনে বিভ্রান্তি বৃদ্ধি পাবে। জেলার প্রকৃত ম্যাজিস্ট্রেট প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকারি চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের পদবির অবমূল্যায়ণ হবে এবং তাদের দায়িত্ব পালনে অসুবিধা সৃষ্টি হবে।

ডিসিগণ মূলত মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের প্রতিনিধি হিসেবে একটি জেলায় নির্বাহী বিভাগের বিভিন্ন দপ্তরের কার্যক্রমের সমন্বয়সাধণ করেন। আমরা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জেনেছি ডিসিগণ জেলায় ৩০২টি কমিটির সভাপতি হিসেবে সমন্বয় করে থাকেন (সূত্র: ঢাকা পোস্ট, দ্যা ফাইনানসিয়াল এক্সপেস)।

আরও পড়ুন: ‘সহকারী জজ’ ও ‘সিনিয়র সহকারী জজ’ পদবির নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব বিচারকদের

সংস্কার প্রাক্কালে জেলা প্রশাসক শব্দের পরিবর্তে যদি অন্য পরিচয় বা নাম প্রদান করতে চাওয়া হয়, তাহলে তাদের মূল দায়িত্ব হিসেবে District Co-Ordinator (DC)  বা জেলা সমন্বয়ক নাম দেয়া যেতে পারে। বিভ্রান্তিমূলক শব্দ ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেট’ ব্যবহার করে মূল পদবি হিসেবে পরিচয় নির্ধারণ সমীচীন হবে না।

ফৌজদারি কার্যবিধি হচ্ছে ম্যাজিস্ট্রেট পদবির ও ক্ষমতার ভিত্তি। উক্ত আইনেই ম্যাজিস্ট্রেটকে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ভাগ করেছে। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে মূল বিচারিক দায়িত্বপালনকারী জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রধান চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট/চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট।

উক্ত আইন অনুসারে প্রশাসনিক ও নির্বাহী প্রকৃতির কাজ এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটদের। একইভাবে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রধান হতে পারে চীফ এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট। এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রধান ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেট’ হওয়ার কোন যৌক্তিক বা আইনি ভিত্তি আছে বলে জানা নাই।

ফৌজদারি কার্যবিধির ৪ক ধারায় বলা আছে কোন বিশেষায়িত শব্দের অনুপস্থিতিতে ম্যাজিস্ট্রেট বলতে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বোঝাবে, অর্থাৎ কোথাও এক্সিকিউটিভ বা জুডিসিয়াল এই ধরণের বিশেষায়িত শব্দ পূর্বে যুক্ত না করে শুধু ম্যাজিস্ট্রেট শব্দ ব্যবহার করা হলে তা জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে বোঝাবে।

এর পেছনে কারণ হচ্ছে মূল ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল কাজ বা বিচারিক কাজ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটগণই করে থাকেন। তাই “জেলা ম্যাজিস্ট্রেট” পদবি যদি রাখতেই হয় তাহলে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসির প্রধান ‘চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট’ পদের নাম পরিবর্তন করে ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেট’ দেয়া যেতে পারে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪ক ধারার ব্যাখ্যা ও ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আইনে প্রদত্ত এখতিয়ার এই যুক্তিকে সমর্থন করে। আমরা আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বিবেচনা করবেন।

লেখক: মতিউর রহমান, জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, বাগেরহাট।