মোঃ ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ্ : ২০২৫ সালের ১৫ জানুয়ারি, সংবিধান সংস্কার কমিশন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে তাদের প্রস্তাবনা জমা দেয়। ড. আলী রীয়াজের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশনের প্রস্তাবের অন্যতম প্রধান দিক ছিল জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন। এই কাউন্সিল গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ এবং বিচার বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
কমিশনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, এনসিসি-তে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, সংসদের উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের স্পিকার এবং ডেপুটি স্পিকার, প্রধান বিচারপতি এবং আইনসভার নিরপেক্ষ সদস্যদের একটি নির্ধারিত অংশ সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবেন। আইনসভার নিরপেক্ষ বা দলহীন সদস্যরা ভোটের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে এনসিসি প্রয়োজনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে অভিযোগ তদন্ত ও অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে।
এই প্রস্তাবিত কাঠামোর একটি উল্লেখযোগ্য সুবিধা হলো এটি ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে শাসন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারবে। সরকারি দল, বিরোধী দল এবং নিরপেক্ষ সাংসদদের প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে এটি শাসন বিভাগের কার্যক্রমে গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারবে। তদ্ব্যতীত, এনসিসি ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করে আইন ও শাসন বিভাগের মধ্যে কার্যকর সম্পর্ক স্থাপনে ভূমিকা রাখতে পারবে। তবে, এই প্রস্তাবের বিপক্ষে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও উঠেছে, বিশেষ করে বিচার বিভাগের উপর এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান ভিত্তি। এটি নিশ্চিত করে যে বিচারকরা নির্বাহী ও আইন বিভাগের প্রভাবমুক্ত থেকে ন্যায়বিচার প্রদান করতে পারবেন। কিন্তু এনসিসি-র কাঠামোতে প্রধান বিচারপতির অন্তর্ভুক্তি এবং তদন্ত ও অনুসন্ধানের জন্য অভিযোগ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে প্রেরণের ক্ষমতা বিচার বিভাগের উপর রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধির শঙ্কা সৃষ্টি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, যদি প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ওঠে, তাহলে এনসিসি-র সদস্য হিসেবে তিনি নিজের বিরুদ্ধে তদন্তে কতটা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবেন, সেটি একটি বড় প্রশ্ন।
এনসিসি-র কার্যক্রমের ইতিবাচক দিক থাকলেও এর নেতিবাচক প্রভাব গভীরভাবে চিন্তা করার দাবি রাখে। প্রস্তাবিত কাঠামোতে রাজনৈতিক প্রভাবের ঝুঁকি থাকায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের নিরপেক্ষতা হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিগত ১০ জানুয়ারি ২০২৫ ইং তারিখে বাংলাদেশ ল অ্যালায়েন্স (বিএলএ) কর্তৃক আয়োজিত “বিচার বিভাগ সংস্কার ভাবনাঃ বিচারক নিয়োগ ও অপসারণ প্রসঙ্গ” শীর্ষক একটি আলোচনায় এনসিসি-র সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি কাঠামো গঠনের প্রস্তাবনা দেওয়া হলে প্রাক্তন হাই কোর্ট ডিভিশনের বিচারক মোঃ মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, “বিচার বিভাগ সর্বদাই শাসন ও আইন বিভাগ থেকে আলাদা রাখতে হবে।” তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন প্রাক্তন হাই কোর্ট ডিভিশনের বিচারক মোঃ আবু তারিক। বিজ্ঞ প্রাক্তন বিচারকদের এই মতামত বিচার বিভাগের উপর রাজনৈতিক প্রভাবের ঝুঁকির বাস্তবতা স্পষ্ট করে।
এনসিসি গঠনের মাধ্যমে যদি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল রাজনৈতিক প্রভাবাধীন হয়, তাহলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা গুরুতরভাবে ব্যাহত হবে। এটি বিচার ব্যবস্থার উপর জনগণের আস্থা নষ্ট করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য কয়েকটি কার্যকর সমাধান বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রথমত, এনসিসি-র কাঠামোতে প্রধান বিচারপতির ভূমিকা ও ক্ষমতা স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করতে হবে। বিশেষত, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্ত পরিচালনার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ও দায়িত্ব সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, এনসিসি-র কার্যক্রমে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। এই কাউন্সিলে রাজনৈতিক দলের সদস্যদের সংখ্যা অধিক হওয়ায় রাজনৈতিক প্রভাবের ঝুঁকি থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল যেন এনসিসি-র অধীনে সম্পূর্ণভাবে চলে না যায়, সে বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তৃতীয়ত, এনসিসি-র ক্ষমতার প্রয়োগ ও কার্যপ্রণালী নিয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে হবে, যা বিচার বিভাগের স্বায়ত্তশাসন অক্ষুণ্ণ রাখতে সহায়ক হবে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা ছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা ও কার্যকারিতা বজায় রাখা সম্ভব নয়। তাই জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন করতে হলে এর সম্ভাব্য প্রভাব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা অপরিহার্য। এমন কোনো কাঠামোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করে। সঠিক কাঠামো এবং কার্যপ্রণালী নিশ্চিত করে এনসিসি গঠিত হলে এটি শাসন ও বিচার ব্যবস্থায় একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে এবং জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক: মোঃ ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ্,সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ল অ্যালায়েন্স (বিএলএ), ই-মেইলঃ ibrahimkhalilullah010@gmail.com