সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের অধ্যাদেশ জারি এবং বাস্তবতার নিরিখে সমালোচনা
মোঃ ওবাইদুল্যাহ আল মামুন সাকিব

সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের অধ্যাদেশ জারি এবং বাস্তবতার নিরিখে সমালোচনা

মোঃ ওবাইদুল্যাহ আল মামুন সাকিব: বাংলাদেশ সংবিধানের ৯৫ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের যোগ্যতা ক) আইনজীবী হিসাবে দশ বছরের প্রাকটিস অথবা খ) অধস্তন আদালতের বিচারক হিসাবে দশ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা। সংবিধানের স্পষ্ট বিধানকে সুপারসিড করে বর্তমান অধ্যাদেশে কমপক্ষে ৪৫ বছর বয়স পূরণ হওয়ার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে। যা সরাসরি সংবিধান লঙ্ঘন এবং অত্যন্ত ন্যক্কারজনক কাজ।

কমিশনের একজন সদস্য হবেন অধ্যাপক বা আইন বিশেষজ্ঞ। প্রশ্ন হলো, বিচারক নিয়োগের জন্য অধ্যাপকের কাজ কী? আর আইন বিশেষজ্ঞ কে? সেই বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা নেই। এমনকি একজন সদস্য নিয়োগ হবেন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারক যিনি বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ হয়েছেন এবং পরবর্তীতে হাইকোর্টের বিচারপতি হয়েছেন।

এটা কী দরকষাকষির বাজার যেখানে কালেকটিভ বারগেইনিং এজেন্ট বা সিবিএ কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে! যদি মনে করা হয় সরাসরি যারা আইনজীবী থেকে বিচারপতি আছেন তাদের একজন এবং লোয়ার জুডিশিয়ারি থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত থেকে একজন, তবে বুঝতে হবে এখানে সিবিএ দরকষাকষি হবে। এটা নিশ্চিতভাবে ধরে নিতে পারেন।

তারুণ্য নির্ভর রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্য থাকলেও এই আইনের অন্যতম ত্রুটি জনগণকে তারুণ্যের শক্তি প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত করা। একজন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী যদি ২৮ বছর বয়সে এনরোলড হন এবং নিয়মিত প্র্যাকটিস করেন তাহলে বর্তমান সংবিধান অনুসারে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হয়ে ৩৮ বছরে তিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হওয়ার জন্য উপযুক্ত হন। কিন্তু বর্তমান অধ্যাদেশ অনুসারে ৪৫ বছরের আগে তিনি অযোগ্য, তাহলে এই সংবিধান লঙ্ঘন করার জন্য বর্তমান আইন উপদেষ্টার দায়বদ্ধতা কী?

এই আইনে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের জন্য গণবিজ্ঞপ্তির বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। সাংবিধানিক আদালতে বিচারক নিয়োগের জন্য আবেদন ফরম পূরণ করা এবং ভাইভা নেয়ার বিধান করা হয়েছে। একটি সাংবিধানিক পদের জন্য ভাইভা বা নিয়োগের জন্য ফাইল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করা সম্ভবত লোয়ার জুডিশিয়ারির বিচারক নিয়োগের মত যা সাংবিধানিক আদালতের জন্য খুবই অসম্মানজনক, মানসিকভাবে অমর্যাদাকর এবং সামগ্রিকভাবে বিব্রতকর।।

এই অধ্যাদেশে কতিপয় উচ্চ বিলাসী এবং সুশব্দ চয়ন করা হয়েছে। একজন প্রার্থীর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সততা, সুনাম বিচারক নিয়োগের জন্য অন্যতম মাপকাঠি হিসেবে ফ্যাক্টর হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই সব মাপকাঠি কিভাবে যাচাই বাচাই করা হবে? সেই বিষয়ে নির্দিষ্ট কোন তরিকা উল্লেখ করেন নি। যার আপেক্ষিক ফলাফল হলো আগের মতই আওয়ামী লীগের নেতারা যাকে মনে করতেন যোগ্য; একইরকমভাবে কাউন্সিলও যাকে মনে করবেন প্রজ্ঞাবান, তিনি হয়ে যাবেন মহা প্রজ্ঞাবান! এটা খুবই অসংলগ্ন এবং অস্পষ্ট অধ্যাদেশ!

মাস খানেক পূর্বে লোয়ার জুডিশিয়ারির বিচারকগন ৭০% তাদের থেকে নিয়োগের জন্য আবদার করেছিলেন। সাংবিধানিক আদালতে একজন বিচারক নিয়োগ হবেন, এটা সম্পূর্ণ নতুন এবং ফ্রেশ নিয়োগ। এখানে কোন কোটার আবদার অযৌক্তিক কেননা লোয়ার জুডিশিয়ারি থেকে হায়ার জুডিশিয়ারির বিচারক নিয়োগ কখনোই “As of Right” নয়। যে কেউ চাইলেই একটা নির্দিষ্ট কোটা দাবি করতে পারে না।

সাংবিধানিক আদালত সংষ্কার করার জন্য বিচারক নিয়োগ, কনফার্মেশন, আইনী কাঠামো সুদৃঢ় করা এবং হাইকোর্টের রায়ের প্রতি রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে আনুগত্য নিশ্চিত করাই ছিল প্রাথমিক দায়িত্ব। অথচ, প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রায়, আদেশ বাস্তবায়নের জন্য আইনজীবীদেরকে কনটেম্পট পিটিশন নিয়ে দৌড়াতে হয়। এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের কঠিন পদক্ষেপ নিশ্চিতে পরিপূর্ণ ক্ষমতা প্রাধান্য পাওয়া উচিত।

বর্তমান আইন মন্ত্রণালয় এবং সুপ্রিম কোর্ট একসাথে ডেপুটেশনে লোয়ার জুডিশিয়ারি থেকে বিচারক নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার অফিস পরিচালনা করছেন। লোয়ার জুডিশিয়ারির বিচারক নিয়োগ হয়েছে জেলা পর্যায়ে জনগণের বিচার কাজ নিশ্চিত করা। অথচ, লোয়ার জুডিশিয়ারির বিভিন্ন আদালতে বিচারক শূন্যতার কারনে জনগণ ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

সম্প্রতি একটা জেলা জজ আদালতে গিয়ে দেখলাম, একজন সিনিয়র সহকারী জজ তিনটি আদালতের দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিদিন মিনিমাম ১০০ মামলা শুনানি করলে সেই বিচারকের অন্যান্য কাজ কীভাবে সম্পন্ন করছেন বা তার মানসিক যন্ত্রণা কী আইন মন্ত্রণালয় বা সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন দেখভাল করছেন?

আইন মন্ত্রণালয় যিনি চালাচ্ছেন, তিনি কী আদৌও বিচার বিভাগ নেতৃত্ব দেয়ার মত ফিট? এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে সুপ্রিম কোর্ট অধস্তন আদালত থেকে প্রেষণে আসা বিচারকের (কাজের মাপকাঠিতে তাদেরকে আমলা হিসেবে উপস্থাপন করা যেতে পারে) বলয় দ্বারা পরিবেষ্টিত। তাদের কাজকর্মে আপনারা আর যাই হোক ডায়নামিজম আশা করতে পারবেন না, রাজনৈতিকভাবে দূরদর্শিতা পাবেন না।

সরাসরি মানুষের উপকার হয় এমন দরদ নাও পেতে পারেন। এসব তাদের কাজও না। একজন বিচারক নিয়োগ হয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়েছেন বিচার নিশ্চিত করার জন্য। কিন্তু প্রশাসন তাকে আমলা বানিয়ে দিয়েছে মাঝে মাঝে। বরং সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন পরিচালনা করার জন্য আলাদা প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করতে পারে।

যারা এই অধ্যাদেশ ড্রাফট করেছেন তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল লোয়ার জুডিশিয়ারির থেকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে সংখ্যা বৃদ্ধি করা। এই অধ্যাদেশ খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন, তারা কোথায় সফল হয়েছে! অধ্যাদেশ প্রয়োগ করতে গেলেই সবচেয়ে বড় বাধা হবে দরকষাকষি।
সাংবিধানিকভাবে লোয়ার জুডিশিয়ারির বিচারকগন কোন অংশেই বঞ্চিত নন অথচ তারা তাদের একটা অযৌক্তিক কোটা অর্জনে সফল হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কোন ভূমিকা এখানে পরিলক্ষিত হয়নি। এই অধ্যাদেশ পাশের মাধ্যমে বিচার বিভাগে সিবিএ কার্যক্রম সূচনা হয়েছে যা সত্যি অনভিপ্রেত।

মোটাদাগে এই অধ্যাদেশ সাংবিধানিক আদালতে বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়াকে কতটুকু সফল করে সেটা দেখার বিষয়। রাজনৈতিক বলয় থেকে বের হতে পারে কী না সেটাও সময় বলে দিবে। বিচারকদের কর্ম স্পৃহা, গতিশীলতা এবং জনগণের ন্যায় বিচারের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হবে কী না সেটা নিশ্চিত করতে পারা বর্তমান অধ্যাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

লেখক: রাজনীতি বিশ্লেষক এবং অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।