ফাইজুল ইসলাম: বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ও বৈচিত্র্যময় দেশে আঞ্চলিক জাতিগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ নিশ্চিত করতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা উপকারী হতে পারে। তবে এটি বাস্তবায়নের আগে যথাযথ গবেষণার মাধ্যমে তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ প্রয়োজন যেন এর আর্থিক ও প্রশাসনিক প্রভাব সামগ্রিকভাবে দেশের জন্য ইতিবাচক হয়। না হয় এটা ছোট গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আমাদের জন্য হুমকির কারণও হতে পারে।
দক্ষিণ আফ্রিকা ১৯৯৪ সালে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সূচনার পর এককক্ষ আইনসভা থেকে দ্বিকক্ষ আইনসভায় রূপান্তরিত হয় তাদের প্রয়োজনে। দেশটির বর্তমান আইনসভা জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক পরিষদের জাতীয় কাউন্সিল National Council of Provinces NCOP নিয়ে গঠিত। এই রূপান্তরের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রাদেশিক সরকারের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা এবং নীতি ও আইন প্রণয়নে ভারসাম্য আনা।
NCOP মূলত প্রাদেশিক স্বার্থকে রক্ষা করার জন্য কাজ করে। প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। কিন্ত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতালগ্ন সময় হতে বাংলাদেশের এককেন্দ্রিক শাসন ব্যাবস্থা বিদ্যমান।
নেপাল একসময় এককক্ষবিশিষ্ট সংসদ বিদ্যমান ছিল। ১৯৯০ সালে নেপালের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পর দেশটি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালু করে। সংসদটি প্রতিনিধি পরিষদ এবং জাতীয় পরিষদ নিয়ে গঠিত। এই পরিবর্তনের লক্ষ্য ছিল আঞ্চলিক ও নৃগোষ্ঠীগত বৈচিত্র্যের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা এবং আইন প্রণয়নে অধিকতর প্রয়োজনীয় ভারসাম্য আনা।
কিন্ত ২০০৬ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর এবং ২০১৫ সালের নতুন সংবিধানের অধীনে নেপাল পুনরায় দ্বিকক্ষ থেকে এককক্ষ আইনসভায় ফিরে আসে। কেননা দ্বিকক্ষ আইনসভা মূলত ছোটদেশগুলোর জন্য অনেকসময় গলার কাটা হয়ে দাঁড়ায়।
দ্বিকক্ষ আইনসভা অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে, তবে এর সঙ্গে কিছু সমস্যাও যুক্ত থাকে। দ্বিকক্ষ ব্যবস্থা আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়াকে ধীর গতিতে করতে পারে। একটি কক্ষে পাস হওয়া আইন আরেকটি কক্ষে যাচাই বা সংশোধনের জন্য পাঠানো হয় যা কখনো কখনো দীর্ঘ সময় নিয়ে নেয়। উদাহরণস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদ আইন পাস করতে অনেক সময় নেয় বিশেষত যদি দুটি কক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে সিনেট ও হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস আইন পাস করতে অনেক সময় লাগে। ২০১৮ সালের দিকে মার্কিন সরকার “শাটডাউনের” মুখোমুখি হয়েছিল কারণ সিনেট এবং হাউসের মধ্যে বাজেট সংক্রান্ত বিল নিয়ে মতবিরোধ হয়েছিল। এমন পরিস্থিতি প্রায়ই দেখা যায়, যেখানে একটি কক্ষে পাস হওয়া বিল অন্য কক্ষে দীর্ঘ সময় ধরে আটকে থাকে।
দ্বিকক্ষ আইনসভা পরিচালনা করতে অতিরিক্ত প্রশাসনিক ব্যয় হয়। দ্বিতীয় কক্ষ পরিচালনা করতে প্রয়োজন হয় আলাদা অবকাঠামো, সদস্যদের বেতন এবং কর্মচারীদের ব্যয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ভারতীয় সংসদে রাজ্যসভার (সিনেট) পরিচালনা ব্যয় প্রায়ই আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। কারণ এটি অনেক সময় “অপ্রয়োজনীয় বিলম্বের উৎস” হিসেবে বিবেচিত দ্বিতীয় কক্ষের প্রতিনিধিদের নিয়োগ বা নির্বাচন প্রক্রিয়া গণতান্ত্রিক হতে নাও পারে।
যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডস সদস্যরা উত্তরাধিকারসূত্রে বা নিয়োগের মাধ্যমে আসন পান যা অনেক সময় সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিতা করে। দ্বিকক্ষ ব্যবস্থায় প্রথম কক্ষে যেসব আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়, দ্বিতীয় কক্ষে তা পুনরায় আলোচনা হতে পারে। এতে আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় সময় ও সম্পদের অপচয় হয়।
উদাহরণস্বরূপ অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টে সিনেট ও হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভসের মধ্যে কখনো কখনো একই বিষয় নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে পুনরাবৃত্তি হয়। অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টের দুই কক্ষ হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস (নিম্নকক্ষ) এবং সিনেট (উচ্চকক্ষ) অনেক সময় একই বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করে। অস্ট্রেলিয়ার আইনসভা ২০১৯ সালে “মেডিকেল ইভাকুয়েশন বিল” নিয়ে দুই কক্ষে বারবার বিতর্ক হয়েছিল যা অপ্রয়োজনীয় সময় অপচয় এবং আইনি প্রক্রিয়া ধীর করে।
John Stuart Mill বলেছেন “A bicameral legislature can often lead to gridlock, where political differences between the two chambers slow down or entirely block the passage of necessary legislation.” অর্থাৎ অনেক সময় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা একটা অচলাবস্থা তৈরি করে।
জন স্টুয়ার্ট মিলের বিরোধিতা করে জেমস মেডিসন বলেছেন, “A bicameral legislature is necessary to maintain checks and balances and avoid dictatorship. It lowers the likelihood of rash or poorly thought-out judgements by guaranteeing that legislation is carefully discussed and improved before becoming law.”
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা সরকারকে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে বাধা দেয়। কারণ নীতিগত সিদ্ধান্ত অধিকাংশ সময় উচ্চকক্ষ থেকে আসে। উচ্চকক্ষে সাধারণত পেশাদার, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় নেতা,পেশাজীবীরা একটা অস্থায়ী বলয় তৈরি করে। অধিকাংশ সময় তারা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের চেয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত বেছে নিতে অভ্যস্ত, পূর্বের অনেক অভিজ্ঞতা তাই বলে।
বাংলাদেশের মূলত একক কোন পদ্ধতিগত আইনসভা ছিল না। মূলত পাকিস্তানের ভাবধারার আদলেই বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ গড়ে ওঠে। যদিও পাকিস্তানের দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা বাংলাদেশ বাহাত্তরের সংবিধান অনুযায়ী অনুসরণ করে নাই। পাকিস্তানের সময়কার দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক পরিষদ বিভিন্ন সমস্যার অভিজ্ঞতা অর্জনের পর স্বাধীন বাংলাদেশে এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠন করা হয়।
একটা প্রবল গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক মহল উচ্চকক্ষ আইনসভা প্রতিষ্ঠার জন্য সরব হয়। সংবিধান কমিটিও নতুন প্রস্তাবনায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রণয়ন করার প্রস্তাব দেন। কিন্ত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রচলনের উদ্যোগ এটিই প্রথম নয়।
এর আগে ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রবর্তনের আলোচনা হয়েছিল যা প্রেসিডেন্টশাসিত ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। তবে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হয়নি।
এরপর ৯০ এর স্বৈরশাসনের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া যখন ৯১ এ ক্ষমতায় আসেন তখন বিভিন্ন মহল থেকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তনের রব ওঠে। গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার পর কিছু রাজনৈতিক মহল উচ্চকক্ষ প্রবর্তনের আলোচনা পুনরায় শুরু করে কিন্ত দ্বৈত আইনসভার কার্যক্রম নিয়ে বিতর্ক থাকায় বাংলাদেশে তখন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা বাস্তবায়ন হয় নাই।
ড. ইউনুস সরকার ক্ষমতায় আসায় পর আবার বাংলাদেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা বাস্তবায়ন করার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে প্রস্তাব আসে। বিভিন্ন সময় উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব তোলা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে বিশেষজ্ঞদের (বিশেষত শিক্ষাবিদ, ধর্মীয় নেতা, সমাজসেবক, অর্থনীতিবিদ, আইনজীবী, ও পেশাজীবী) আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখার সুযোগ দেবে। কেননা শুধুমাত্র সংসদের হাতে আইন প্রণয়ন ক্ষমতা ছেড়ে দিলে গণবিরোধী আইন যেমন :(ডিজিটাল সিকিউরিটি আক্ট, ২০১৮) এর মত আইন তৈরি হতে পারে। কেননা বিগত তিনটি সংসদে আমরা রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এর চেয়ে সংসদে ব্যবসায়ীক নেতাই বেশি দেখেছি।
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা স্ক্রীনিং-এর সুযোগ দেয়, দেশের প্রয়োজন ও জনমতের উপর ভিত্তি করে আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। ড. আলী রীয়াজ সংবিধান প্রস্তাবনায় উল্লেখ করেন নিম্নকক্ষের ৪০০ আসনের মধ্যে ১০০ আসন নারীদের জন্য বরাদ্দ থাকবে। দেশের সংরক্ষিত আসনের সদস্যরাও সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন। উচ্চকক্ষের সদস্যদের কার্যকরী প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে।
বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষে আসন বরাদ্দ করা হবে। উচ্চকক্ষে সংখ্যালঘু, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী, আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার বিধান থাকবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে ১০০ জন উচ্চকক্ষ সদস্যের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচজন প্রান্তিক গোষ্ঠীর সদস্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। রাষ্ট্রপতি অরাজনৈতিক নাগরিকদের মধ্য থেকে তার মর্জি অনুযায়ী (Doctrine of Pleasure) পাঁচজনকে মনোনীত করতে পারবেন।
দেখা যাক, ছোট গণতান্ত্রিক দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা কতটা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। ধনী রাষ্ট্র নরওয়ে একসময় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা চালু রেখেছিল। এরপর ২০০৯ সালে তারা এককক্ষবিশিষ্ট সংসদ গ্রহণ করে। ছোট গণতান্ত্রিক দেশের জন্য দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা অনেক সময় ব্যয়সাপেক্ষ, অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। সিঙ্গাপুর, নিউজিল্যান্ড এবং নরওয়ের মতো দেশগুলো এ ধরনের সমস্যার প্রত্যক্ষ উদাহরণ এবং তারা কার্যকর এককক্ষবিশিষ্ট ব্যবস্থা চালু রেখে সফল হয়েছে।
লেখক: প্রভাষক, আইন ও বিচার বিভাগ, দ্যা পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।