সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের অধ্যাদেশ জারি এবং বাস্তবতার নিরিখে সমালোচনা
মোঃ ওবাইদুল্যাহ আল মামুন সাকিব

সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী, শেখ মুজিবুর রহমানের দায়বদ্ধতা

মোঃ ওবাইদুল্যাহ আল মামুন সাকিব: ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে ইতিহাসের কালো অধ্যায় সৃষ্টি করেছিল ২৫শে জানুয়ারি ১৯৭৫ এর সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী। রাজনীতির ইতিহাসের একটি কালোদিন আজকের ২৫শে জানুয়ারি।

লাখো শহিদের রক্ত রঞ্জিত এই জনপদ এবং বাংলার মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে এদেশের জনগণের স্বাধীনতার আশা আকাঙ্ক্ষা পূর্ণতা লাভ করে। যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের জন্য একটা নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা এবং রাষ্ট্র কাঠামোকে পূর্ণতা দেয়ার জন্য প্রণীত হয়েছিল সংবিধান।

বাংলাদেশ সংবিধানের প্রস্তাবনায় গৃহীত হয়েছিল “আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে”

সংবিধানের মূলনীতি থেকে বহুদূর সরে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনী করে নিজ হাতে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করে নেন। মাত্র ১১ মিনিটে ইতিহাসের এক বিতর্কিত সাংবিধানিক পটপরিবর্তন হয় যার পরিপ্রেক্ষিতে এদেশের জনগণের গনতান্ত্রিক অধিকার বিলুপ্ত হয়ে যায়।

২৫শে জানুয়ারি ১৯৭৫, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের রোডম্যাপ তৈরি করেন। গণতন্ত্রকে গলাটিপে হত্যা করে, রাজনৈতিক দলগুলোর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে এক দল এক নেতার সরকার ব্যবস্থা ‘বাকশাল’ কায়েম করে।

আরও পড়ুনসুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের অধ্যাদেশ জারি এবং বাস্তবতার নিরিখে সমালোচনা

শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে এবং নিজের বিরুদ্ধে কোন সমালোচনা যাতে না করতে পারে সেই উদ্দেশ্যে সকল সংবাদপত্র বাতিল করে নিজের অনুগত চারটি পত্রিকা চালু রাখার ফরমান জারি করে। নিয়ন্ত্রিত সাংবাদিকতার কালচার সৃষ্টি করে জনগণের কণ্ঠরোধ করতে দ্বিধাবোধ করেন নি। অবহেলিত জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের লালিত সংগ্রামের ফলে অর্জিত স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। চতুর্দিকে রাষ্ট্র কর্তৃক বর্বরতা ছড়িয়ে পড়ে! দেখার কেউ ছিল না! প্রতিবাদ করার মত কারো সাহস ছিল না!

ওয়েস্ট মিনিস্টার স্টাইল থেকে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা চালু করে শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠেন এক অস্পৃশ্য ক্ষমতাধর পুরুষ। ১৯৪৭-৭১ এর দীর্ঘ ২৩ বছরের শোষণ থেকে জনগনের মুক্তি জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী শেখ মুজিবুর রহমানই পরবর্তীতে হয়ে গেলেন ক্ষমতার অপব্যবহারকারী।

৭০ এর নির্বাচনে জয়ী হয়ে শেখ মুজিবুর রহমানই হতেন অখণ্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু জুলফিকার আলি ভুট্টো গংদের টালবাহানায় যখন প্রধানমন্ত্রীত্বের দায়িত্ব নিতে ব্যর্থ হলেন তখনি এদেশের জনগণকে সাথে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলন করেছিলেন।

জনগণ শেখ সাহেবের আহ্বানে নিজেদের রক্ত বিলিয়ে দিতে পিছপা হননি অথচ সেই শেখ সাহেব যখন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে তখনি জনগণের ইচ্ছা, আকাঙ্খাকে পদদলিত করতে চিন্তা করেননি।

১৯৭৫ সালে ২৫শে জানুয়ারি থেকে ১৫ই আগস্ট। মাত্র ০৭ মাসের ব্যবধানে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে সেনাবিদ্রোহ হয়েছিল। আগস্ট বিপ্লব/অভ্যুত্থান শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন অবসান ঘটে। গণতন্ত্রবিরোধী ও জনবিচ্ছিন্ন একদলীয় শাসনের নায়ক শেখ মুজিবুর রহমান মৃত্যুর পর এদেশের জনগণের প্রতিক্রিয়াই প্রমাণ করেছিল।

১৯৭১ এর মহানায়ক ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে ভিলেন হয়ে উঠেন। রাজনৈতিক অর্জন অতিদ্রুত বিনাশ হয়ে যায় যা উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। যেখানে শেখ মুজিবুর রহমান হতে পারতেন জনআকাঙ্ক্ষা পূরণকারী সেখানে বিতর্কিত হয়ে জীবনের অবসান ঘটে।

লেখক: রাজনীতি বিশ্লেষক এবং অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।