বুক রিভিউ : হাসির ট্যাবলেট 'বলা বাহুল্য'
বুক রিভিউ : হাসির ট্যাবলেট 'বলা বাহুল্য'

বুক রিভিউ : হাসির ট্যাবলেট ‘বলা বাহুল্য’

মাদক মামলায় জামিন শুনানী চলছে। হ্যাংলা-পাতলা গড়নের যুবক অবিনাশকে সামান্য গাজাসহ হাতেনাতে গ্রেফতার করেছেন পুলিশ। তার জামিনের জন্য দাঁড়িয়েছেন শহরের প্রখ্যাত আইনজীবী প্রফুল্ল বাবু।

জামিন শুনানির এক পর্যায়ে একঘেয়েমি আইনি কথার মাঝে শুরু হয় বিচারক-আইনজীবীর রম্য কথামালা। সেগুলো পড়তে পড়তে মনে হলো এ যেন আমার আদালতেই শুনানি চলছে। পড়ছি আর হাসছি। শুনানি শেষে বিজ্ঞ আইনজীবীর চমৎকার উপস্থাপনা, মাদকের পরিমাণ ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় অবিনাশের জামিন হয়। এই গল্প বলতে গিয়ে লেখক একজন ভালো আইনজীবীর মানের প্যারামিটার গুলো নিয়েও কথা বলেছেন খোলা মনে।

গল্পের শেষ এখানেই নয়। দুই বছর পর আসামি অবিনাশ ও তার আইনজীবী প্রফুল্ল বাবু অকল্পনীয় টুইস্ট নিয়ে হাজির হয়ে গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। আদালতনামা গল্পের মাঝেই আছে আরো দুটো বোনাস গল্প। সাইদুর-বেলীর অমর প্রেম ও বেলীর আনীত মামলায় সাইদুরের জামিন নামঞ্জুরের প্রেক্ষিতে উদ্ভূত ঘটনাবলী, চিকন বুদ্ধির আদালত পিয়ন আনোয়ারের দুষ্কর্ম ও শাস্তি ইত্যাদি বিষয়াবলী পড়ার পর মনে হচ্ছে এগুলোতো আমাদেরই গল্প, যে গল্পের চরিত্ররা ঘুরে বেড়ায় আমাদের চারপাশে।

বলছিলাম বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘বলা বাহুল্য’ এর ‘আদালতনামা’ গল্প থেকে। বইটি লিখেছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগের মাননীয় রেজিস্ট্রার (জেলা ও দায়রা জজ) হাসানুজ্জামান রিপন মহোদয়। মার্জিত রুচি, বুদ্ধির দীপ্তি, অপূর্ব বাকচাতুর্য ও স্মিত রসিকতায় লেখকের প্রতিটি গল্প পড়ে মনে হয়েছে তাঁর রয়েছে বিশাল পাঠ সম্ভার ও অভিজ্ঞতার ঝুলি। এ দুইয়ের সংমিশ্রণে অসাধারণ শব্দ চয়নে রম্যের ডালি বুনেছেন সুনিপুণভাবে। তাই লেখককে ‘শব্দের জাদুকর’ বললে অত্যুক্তি হবে না। ‘বৈকুন্ঠের রোদ পোহানো’ এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ; যেখানে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, শরৎচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র, বুদ্ধদেব আর হুমায়ূন আহমেদদের কাল্পনিক কথোপকথন সত্যিই অসাধারণ।

রম্য লেখকের অন্যতম কাজ লেখালেখির মাধ্যমে সমাজের আধমরাদের ঘা দেওয়া এবং সমসাময়িক সমস্যার বেড়াজাল ছিন্ন করা। তাইতো লেখক ‘লজ্জা’ গল্পে সমসাময়িক সামাজিক অসঙ্গতি তুলে ধরে বলেছেন, ”লজ্জা তখন নিজেই আহাম্মক হয়ে নির্বাক হয়ে যায়।” আবার ‘ভাঁড়ুয়া’ প্রবন্ধে পুরুষদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ”পৃথিবীর সব পুরুষই জন্মসূত্রে ভাঁড়ুয়া নয়কি!”

বইটির অধিকাংশ গল্প বা প্রবন্ধে কেন্দ্রীয় চরিত্র লেখকের সহধর্মিনী ‘আষাঢ়স্য রসনা বিলাপ’ ও ‘শাপে বর’ গল্পের নায়িকা শ্রদ্ধেয় মৌসুমী ভাবি। কখনোবা তিনি এসেছেন ‘নির্বাক ভাষা’য় চামেলী হয়ে, ‘সভ্যতা’ গল্পে শম্পা হয়ে, কখনোবা ’বিড়ালকাণ্ড’ গল্পে শরবতি বেগম হয়ে। ‘বিড়ালকান্ড’ পড়লে পাঠক বউকে শান্ত রাখার এক অভূতপূর্ব টেকনিক খুঁজে পাবেন তা আমি নিশ্চিত।

জীবনে কম-বেশি সকলেরই বমির অভিজ্ঞতা রয়েছে। ‘বমি’ গল্পে এসাহাক মামা আর সুফিয়া খাতুনের গল্পটা পড়লে হাসতে হাসতে আপনারও বমি হয়ে যেতে পারে। তবে বিপুলের বমি কাহিনীটা দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত এক যুবকের কঠিন বাস্তবতাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাবে। এভাবে রম্যের সাথে সমাজ ও ব্যক্তি সম্পর্কে তীক্ষ্ণ অনুভূতি লেখক অত্যন্ত সুন্দর ও সাবলীলভাবে মিশিয়েছেন।

বইটি পড়তে গিয়ে একদিকে পেয়েছি শহরে আধুনিকতা, অন্যদিকে পেয়েছি গ্রামীণ স্নিগ্ধতা। এ দুটোর অপূর্ব সমন্বয়ে লেখকের লেখাগুলো এক অনন্য বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে। নিজ গ্রামে বাসের লিকে নাক লাগিয়ে পেট্রোলের গন্ধ শুঁকে বাচ্চাদের নাকে মুখে ধুলা লাগানোর বিবরণ আমাকে নস্টালজিক করে তুলেছে। ‘হেডস্যার’ গল্পটি পড়তে গিয়ে বারবার নিজের কাদামাটি মাখানো শৈশবের কথাই মনে পড়েছে। গল্পের শেষের দিকে এক ধরনের অদ্ভুত উল্টো ভাষা আছে। শৈশবে আমি নিজেও এ ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতাম। পুরো বই পড়তে গিয়ে হেসেছি হা হা, হি হি, হো হো করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে – যেন কেউ আমাকে নাইট্রাস অক্সাইড (লাফিং গ্যাস) খাইয়ে দিয়েছে।

শুধুই যে হেসেছি তা নয়, কখনও কখনও ব্যথিতও হয়েছি। কষ্ট পেয়েছি ক্লাশের সবচেয়ে ভালো ছাত্র বলে খ্যাত নিরপরাধ মেহেদীর ৩৭ বেত্রাঘাতের শাস্তি দেখে। বেচারা অবিচারের শিকার হয়ে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। দোষ না করেও শাস্তি পাওয়ার নজির আমারও আছে। এতকিছুর পরেও কিছু মুদ্রন প্রমাদ চোখে পড়েছে। আশা করছি, পরবর্তী মুদ্রনে প্রকাশক সেই বিষয়টিতে নজর দেবেন। লেখকের প্রতি অনুরোধ তিনি যেন এভাবেই লিখতে থাকেন অবিরত। তাঁর লেখনীতে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি হোক সমৃদ্ধ।

চমৎকার ও দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদের বইটি প্রকাশ করেছেন দেশের খ্যাতনামা প্রকাশনী অন্যপ্রকাশ। ১২৭ পৃষ্ঠার বইটির প্রচ্ছদ মূল্য ৪০০ টাকা হলেও রকমারিতে পাওয়া যাচ্ছে ২৫% ছাড়ে। পাওয়া যাবে বইমেলায় অন্যপ্রকাশের প্যাভিলিয়নেও। অত্যন্ত জনপ্রিয় এই বইটি বইমেলায় প্রথম প্রকাশের কথা থাকলেও মুদ্রনের মাত্র ০৩ দিনের মধ্যেই প্রি-অর্ডারে সকল কপি শেষ হয়ে গিয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, এখন দ্বিতীয় মুদ্রণের কপি পাওয়া যাচ্ছে। হ্যাপি রিডিং।

লেখক : মো. সাইফুল ইসলাম পলাশ, অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, রাজশাহী।