মোঃ সরোয়ার হোসাইন লাভলু: গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো সুষ্ঠু ও কার্যকর নির্বাচন। একটি দেশ গণতান্ত্রিকভাবে কতটা শক্তিশালী, তা নির্ভর করে তার নির্বাচনব্যবস্থার ওপর।
জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন—দুটিই গণতন্ত্রের অপরিহার্য অংশ। তবে এ দুটি নির্বাচনের যথাযথ ক্রমবিন্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি শাসনব্যবস্থা, প্রশাসনিক কার্যকারিতা ও গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।
বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন পরিচালনার বিভিন্ন মডেল থাকলেও অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশে জাতীয় নির্বাচন আগে অনুষ্ঠিত হয় এবং তার ভিত্তিতেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরিচালিত হয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
জাতীয় নির্বাচন আগে হওয়া কেন গুরুত্বপূর্ণ?
১. শাসনব্যবস্থার স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ
জাতীয় নির্বাচন দেশের সর্বোচ্চ শাসনব্যবস্থা নির্ধারণ করে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হয়, নীতিনির্ধারণ হয় এবং প্রশাসনিক কাঠামো শক্তিশালী হয়। যদি স্থানীয় নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত হয়, তবে প্রশাসনের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কোন নীতির আওতায় কাজ করবেন, তা অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।
জাতীয় সরকার আগে গঠিত হলে প্রশাসনিক কাঠামো সুসংহত থাকে, ফলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা একটি নির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন।
২. কেন্দ্রীয় নীতিমালার অভাব দূরীকরণ
জাতীয় নির্বাচন ছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে নতুন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাজ করার ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা দেখা দেবে। তারা কীভাবে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করবেন? কোন বাজেট অনুমোদিত হবে? প্রশাসনিক নীতিমালা কী হবে? এসব প্রশ্নের কোনো সুস্পষ্ট উত্তর থাকবে না।
জাতীয় নির্বাচন আগে হলে, সরকার একটি সুসংগঠিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে পারে এবং স্থানীয় সরকার সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করতে পারে। এতে প্রশাসনিক সমন্বয় নিশ্চিত হয়।
৩. জাতীয় নির্বাচনের স্বচ্ছতা রক্ষা
যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের আগে হয়, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো স্থানীয় প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করতে পারে, যা জাতীয় নির্বাচনের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।
এছাড়া, স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফলকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় নির্বাচনে কৌশল সাজানোর চেষ্টা করতে পারে, যা ভোটারদের স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
৪. রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ভারসাম্য বজায় রাখা
জাতীয় নির্বাচন ছাড়া স্থানীয় নির্বাচন হলে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে। দলগুলো স্থানীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে জাতীয় নির্বাচনে সুবিধা নেওয়ার কৌশল অবলম্বন করতে পারে, যা গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ।
জাতীয় নির্বাচন আগে হলে, রাজনৈতিক দলগুলো একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশ নেয় এবং জাতীয় পর্যায়ে ক্ষমতার ভারসাম্য নির্ধারিত হওয়ার পর স্থানীয় সরকার গঠিত হয়। এতে রাজনৈতিক অস্থিরতা হ্রাস পায়।
৫. জনগণের আস্থা ও অংশগ্রহণ বৃদ্ধি
জাতীয় নির্বাচন আগে হলে, জনগণের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট ধারণা থাকে যে দেশ কোন পথে পরিচালিত হবে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়ার ফলে জনগণ আরও স্বাধীনভাবে স্থানীয় নির্বাচন করতে পারে, যা ভোটারদের আস্থা বাড়ায় এবং প্রকৃত জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পান।
৬. জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের সুসমন্বয় নিশ্চিতকরণ
জাতীয় সরকার থাকলে স্থানীয় সরকার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আরও কার্যকর হয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তখন জাতীয় সরকারের নীতির আলোকে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারেন। জাতীয় নির্বাচন আগে হলে প্রশাসনিক সমন্বয় সহজ হয় এবং সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব হয়।
জাতীয় নির্বাচন পরবর্তী স্থানীয় নির্বাচন: একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক মডেল
প্রতিটি নির্বাচনের একটি স্বতন্ত্র গুরুত্ব আছে, কিন্তু জাতীয় নির্বাচন আগে হলে স্থানীয় সরকারের কার্যকারিতা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও এই মডেল অনুসরণ করা হয়।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় জাতীয় নির্বাচনের পর স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করাই সবচেয়ে যৌক্তিক ও গণতন্ত্রের জন্য উপকারী। এতে প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা, জাতীয় সরকারের কার্যকারিতা এবং স্থানীয় সরকারের সঠিক পরিচালনা নিশ্চিত হয়।
একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে নির্বাচনব্যবস্থা সুসংগঠিত হতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন হলে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক জটিলতা তৈরি হবে, যা গণতন্ত্রকে দুর্বল করতে পারে।
তাই বাংলাদেশের মতো একটি উদীয়মান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জাতীয় নির্বাচন আগে হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে, প্রশাসনিক কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে এবং জনগণের আস্থা বজায় রাখে। জাতীয় সরকারের ভিত্তি মজবুত হলে স্থানীয় সরকারও কার্যকর হয়, যা সার্বিক উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
লেখক: অ্যাডভোকেট মোঃ সরোয়ার হোসাইন লাভলু, অতিরিক্ত জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর, চট্টগ্রাম।