বাংলাদেশে বিচারপ্রার্থী মানুষের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে, ফলে আদালতের উপর চাপও বাড়ছে। এই বাস্তবতায় ২০২৫ সালের সংশোধিত আইনগত সহায়তা প্রদান আইন অনুযায়ী কিছু নির্দিষ্ট ধরণের মামলায় বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা চালু করা হয়েছে। সরকারের দাবি—এটি বিচারপ্রক্রিয়াকে আরও দ্রুত, সহজ, এবং সাশ্রয়ী করে তুলবে। তবে এর বিরোধিতাও রয়েছে, বিশেষত নারী ও শিশু নির্যাতনের মতো সংবেদনশীল মামলায় বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতার সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে। এই প্রবন্ধে লেখক মো. জুনাইদ একজন সাবেক লিগ্যাল এইড অফিসার হিসেবে বাস্তব অভিজ্ঞতা ও আইনি যুক্তির ভিত্তিতে এই আইনটির প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাবনা তুলে ধরেছেন।
১. আদালতের জট কমানো ও বিচার ব্যবস্থাকে কার্যকর করা
বর্তমানে দেশের আদালতগুলোতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় ৪৩ লাখ। বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেটরা প্রতিদিন গড়ে ৬০–৭০টি মামলা শুনানির চাপে থাকেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে আপোষযোগ্য মামলাগুলো (যেমন তালাক, ভরণপোষণ, চেক ডিজঅনার, যৌতুক, ১১(গ)) আদালতে না তুলে মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করলে বিচার ব্যবস্থার উপর চাপ কমবে এবং জট কমবে। Law Commission Report, 2022 অনুযায়ী, বিচার প্রক্রিয়ায় বিলম্বের অন্যতম প্রধান কারণ হলো অপ্রয়োজনীয় মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি। বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা এই প্রবণতা রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
২. সংবিধানের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ
বলা হচ্ছে, বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা সংবিধানের ২৭ ও ৩১ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। কিন্তু বাস্তবে, এই আইন আদালতের দোরগোড়ায় যাওয়ার অধিকারকে বাতিল করে না বরং “প্রথমে বিকল্প চেষ্টা করো, ব্যর্থ হলে আদালতে যাও”— এমন একটি পরামর্শমূলক কাঠামো তৈরি করে, যা বহু দেশে ব্যবহৃত হয়। ভারতের Section 12A of the Commercial Courts Act, 2015 এমনই বাধ্যতামূলক প্রি-লিটিগেশন মিডিয়েশন চালু করেছে এবং সুপ্রিম কোর্ট তা বৈধ বলেছে।
৩. SDG Goal 16 অর্জনে সহায়ক
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG)-র Goal 16 হলো, “Access to Justice for All”। বাধ্যতামূলক ADR, বিশেষত মধ্যস্থতা, এই লক্ষ্য পূরণে অন্যতম কার্যকর মাধ্যম হতে পারে। কারণ, এটি মানুষকে ন্যূনতম খরচে, দ্রুত এবং অপ্রতিরোধ্য নয় এমন সমাধান দেয়।বাংলাদেশের মতো স্বল্প আয়ের দেশে, যেখানে গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগণ বিচারব্যবস্থা থেকে দূরে থাকে, সেখানে মধ্যস্থতা একটি সাশ্রয়ী ও সহানুভূতিশীল ন্যায়বিচার ব্যবস্থার দ্বার খুলে দেয়।
আরও পড়ুন : বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা: ন্যায়বিচারে বিকল্প পথ, না নতুন সংকট?
৪. নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলায় সুরক্ষাবান্ধব ব্যতিক্রম রাখা হয়েছে
আইনে বলা হয়েছে, মিডিয়েশন হবে “সম্মানজনক, নিরাপদ ও সুরক্ষিত পরিবেশে” এবং ব্যর্থ হলে যেকোনো পক্ষ আদালতে যেতে পারবেন। তদ্ব্যতীত, নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলায় শুধুমাত্র ১১(গ) ধারা, যা আপোষযোগ্য, সেখানে মধ্যস্থতার সুযোগ রাখা হয়েছে—যেখানে আপোষ না হলে অপরাধী বিচারের মুখোমুখি হবে। কাজেই GBV/VAW মামলার ক্ষেত্রে কোনো “immunity” তৈরি হয়নি বরং শুধু আইনি কাঠামোর ব্যালান্সড প্রয়োগ নিশ্চিত করা হয়েছে।
৫. অভিজ্ঞতা থেকে শেখা—বাংলাদেশের ADR ইতোমধ্যেই সফল
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অর্গানাইজেশন (NLASO), BRAC, ও BLAST-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, গত এক দশকে পারিবারিক বিরোধে ৭০–৮০% মধ্যস্থতা সফল হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে সময়, অর্থ ও মানসিক যন্ত্রণার যেটুকু কমে এসেছে, তা বিচারপ্রার্থীদের জন্য একটি বাস্তব সুবিধা।BLAST Annual Report 2023 দেখায়—একটি পারিবারিক বিরোধের মামলার গড় নিষ্পত্তি সময় যেখানে আদালতে ১–৩ বছর, সেখানে ADR-এ মাত্র ১৫–৩০ দিন।
৬. চেক ডিজঅনার মামলায় অপরাধীদের দায় এড়ানোর সুযোগ নয়
চেক ডিজঅনার ধারা ১৩৮ অনুযায়ী একটি জামিনযোগ্য অপরাধ এবং এটি আপোষযোগ্য। বাধ্যতামূলক ADR এখানে সময় কেনার সুযোগ নয় বরং ব্যবসায়িক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন, দ্রুত ক্ষতিপূরণ আদায় এবং আদালতের সময় বাঁচানোর জন্য কার্যকর ব্যবস্থা। বাদী যদি দেখতে পান, অপর পক্ষ বারবার অনুপস্থিত থাকে, তাহলে আদালতে যাওয়ার পথ খোলা রয়েছে। এছাড়া ADR প্রক্রিয়া ব্যর্থ ঘোষণার সময়সীমাও নির্ধারিত থাকবে, যাতে অপব্যবহার না হয়।
৭. আইনজীবীদের ভূমিকাকে দুর্বল করা নয়, বরং নতুন সুযোগ সৃষ্টি
মধ্যস্থতায় আইনজীবীর উপস্থিতি নিষিদ্ধ নয়; বরং আইনের আলোকে পার্টির ইচ্ছানুযায়ী আইনজীবী নিতে পারেন। এছাড়া ADR-এর প্রসারে আইনজীবীদের জন্য নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে—যেমন: ট্রেইন্ড মিডিয়েটর, ফ্যাসিলিটেটর, লিগ্যাল কনসালট্যান্ট ইত্যাদি। ভারত, নেপালসহ অনেক দেশে আজ ADR-ভিত্তিক আইনজীবী পেশা অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং সম্মানজনক।
৮. লিগ্যাল এইড অফিসারদের দক্ষতা ও অবকাঠামো উন্নয়নের প্রক্রিয়া চলছে
সচেতনতা, প্রশিক্ষণ, ও প্রযুক্তির মাধ্যমে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসগুলোকে আরও সক্ষম ও আধুনিক করে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। সরকারের Vision 2041 অনুযায়ী, E-Legal Aid, Case Tracking System, AI-supported Case Matching চালুর প্রস্তুতি রয়েছে, যা অফিসারদের উপর চাপ হ্রাস করবে।
৯. আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও বাধ্যতামূলক ADR একটি প্রমাণিত মডেল
অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, ব্রাজিল—এসব দেশে বহু ধরনের মামলায় বাধ্যতামূলক ADR প্রি-কন্ডিশন হিসেবে চালু রয়েছে, এবং তা সফলভাবে বিচারব্যবস্থার দক্ষতা বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ সেই পথ অনুসরণ করছে—বিচারকে “মানবিক ও কার্যকর” করার লক্ষ্যে।
উপসংহার
২০২৫ সালের সংশোধিত লিগ্যাল এইড আইন কোনোভাবেই বিচারপ্রাপ্তির অধিকার হরণ করে না; বরং তা একটি ধাপে সমঝোতা চেষ্টা করে ন্যায়বিচারের পথকে আরো দ্রুত, কম খরচে ও মানুষের নাগালে আনার চেষ্টা মাত্র। মধ্যস্থতা বাধ্যতামূলক হলেও, তাতে অংশগ্রহণকারী কারও অধিকার ক্ষুন্ন হয় না, বরং পক্ষগুলোর মধ্যে সাংঘর্ষিক অবস্থান থেকে সমাধানের পথে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
এই আইনের মাধ্যমে “ন্যায়বিচার” আর “সমঝোতা”—এই দুই ধারণার মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে, যেখানে প্রতিটি নাগরিক যেন আইন ও রাষ্ট্রের সেবাকে সহজ, স্বল্পমেয়াদী, ও মানবিকভাবে পেতে পারেন।
লেখক : মো. জুনাইদ; সাবেক জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা।