রংপুর শিশু পুনর্বাসনকেন্দ্রে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে আদালতের স্বপ্রণোদিত মামলা

রংপুর সমন্বিত শিশু পুনর্বাসনকেন্দ্র (বালিকা)–এ শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন প্রকাশ্যে আসার পর বিষয়টি আমলে নিয়েছে আদালত।

গত ২৯ জুন রংপুর মেট্রো কোতোয়ালি সিআর আমলি আদালতের বিচারক, অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাশেদ হোসাইন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনসমূহ পর্যালোচনা করে স্বপ্রণোদিত হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন।

প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে জানা যায়, পুনর্বাসনকেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্তদের নির্যাতনের কারণে চার কিশোরী পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাওয়া একটি কিশোরীর চুল কেটে দেওয়া হয় এবং কেন্দ্রের অনিয়ম গোপন রাখতে তার ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয় বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। একজন ভিকটিমের মা তাকে দেখতে গেলে পুনর্বাসন কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের দুর্ব্যবহারের সম্মুখীন হন।

জানা যায়, গত ১২ জুন নিখোঁজ হওয়া চার কিশোরীর মধ্যে এখনও দু’জনের সন্ধান মেলেনি। এমন প্রেক্ষাপটে আদালত মনে করে, জনস্বার্থে এবং ন্যায় বিচারের স্বার্থে পুরো ঘটনা তদন্ত প্রয়োজন। ফলে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-এর পুলিশ সুপারকে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ২৯ জুলাই তারিখ নির্ধারণ করেছেন আদালত।

এদিকে, নিখোঁজ হওয়ার ২১ দিন পর গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ওই পুনর্বাসনকেন্দ্র থেকে পালিয়ে যাওয়া কিশোরী রিতু আদালত চত্বরে এসে আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীদের কাছে আশ্রয় চান।

তিনি জানান, পুনর্বাসনকেন্দ্রে তাকে ও অন্যান্য কিশোরীদের বারবার ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে। রিতু বলেন, প্রতিদিন বাইরে থেকে বিভিন্ন পুরুষ পুনর্বাসনকেন্দ্রে এসে মেয়েদের ধর্ষণ করত।

তিনি আরও জানান, নির্যাতনের ভয়ে তিনি স্মৃতি, কৃতি ও আশার সঙ্গে পালিয়ে যান এবং এক আত্মীয়ার বাড়িতে আশ্রয় নেন।

আরও পড়ুনবাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা: ন্যায়বিচারে বিকল্প পথ, না নতুন সংকট?

আইনজীবীরা রিতুকে নিরাপত্তার স্বার্থে পিবিআইয়ের হাতে তুলে দেন। পিবিআই তদন্ত ও নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছে বলে জানায়।

পিবিআই রংপুরের পরিদর্শক মিন্টু চন্দ্র বণিক জানান, শিশুদের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় তদন্ত চলছে এবং যথাযথ জিজ্ঞাসাবাদ শেষে প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়া হবে।

এদিকে, আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী জোবাইদুল ইসলাম বলেন, সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীন পুনর্বাসনকেন্দ্রটি দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতনের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে।

তিনি অভিযোগ করেন, যেসব শিশুর আত্মীয়স্বজন ছিল না, তারা নির্যাতনে মারা গেলে তাদের বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে, কোনো ময়নাতদন্ত ছাড়াই।

তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, আদালতের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে এবং অপরাধীদের বিচার হবে।

রংপুর নগরীর দেওডোবা ডাংগীরপাড় এলাকায় অবস্থিত এই পুনর্বাসনকেন্দ্র থেকে ১২ জুন রাতে রিতু, স্মৃতি, কৃতি ও আশা নামে চার কিশোরী নিখোঁজ হয়।

১৫ জুন পরিবারের সদস্যরা স্মৃতি ও কৃতিকে উদ্ধার করে পুলিশের মাধ্যমে পুনর্বাসনকেন্দ্রে পাঠান। পরে পরিবারের আপত্তিতে ২৫ জুন আদালতের মাধ্যমে স্মৃতিকে পরিবারের জিম্মায় নেওয়া হয়।

স্মৃতি অভিযোগ করেন, গণমাধ্যমে কথা বলায় তাকে মানসিক নির্যাতন করা হয় এবং জোরপূর্বক চুল কেটে দেওয়া হয়। এই চার কিশোরীর মধ্যে এখন পর্যন্ত একজন, আশা, এখনও নিখোঁজ।

এই বিষয়ে পুনর্বাসনকেন্দ্রের অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, “মেয়েরা স্বেচ্ছায় পালিয়েছে, কোনো নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি।”

তবে পালানোর ঘটনায় দায়িত্বরত আউটসোর্সিং কর্মী রুমা বেগমকে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এই ঘটনার মাধ্যমে দেশের শিশু পুনর্বাসন ব্যবস্থার ভয়াবহ দুর্বলতা ও অব্যবস্থাপনা সামনে চলে এসেছে, যা সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার ছাড়া বন্ধ হওয়ার নয়।