বাংলাদেশের ইতিহাসে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক কালো অধ্যায়ের নাম ‘আয়নাঘর’। বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক গোপনে এই ‘আয়নাঘর’ এবং অন্যান্য অনুরূপ গোপন বন্দিশালা বা ডিটেনশন সেন্টার গড়ে তোলা হয়।
এইসব বন্দিশালায় কোনও আদালতের পরোয়ানা ছাড়াই, কোনও বিচার প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই, বহু মানুষকে গুম, বেআইনিভাবে আটক ও বর্বর নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি অনেক মৃতদেহ পর্যন্ত ফেরত দেয়া হয়নি যা আন্তর্জাতিক আইনে ‘enforced disappearance’ হিসেবে বিবেচিত এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ।
এইসব ঘটনা বাংলাদেশের সংবিধানের একাধিক অনুচ্ছেদের সরাসরি লঙ্ঘন। বিশেষ করে অনুচ্ছেদ ৩২ (ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার), অনুচ্ছেদ ৩৩ (গ্রেপ্তারের পর আদালতে পেশের অধিকার ও আইনজীবীর সহায়তা), এবং অনুচ্ছেদ ৩৫(৫) (নির্যাতন, নিষ্ঠুর বা অমানবিক দণ্ডের বিরুদ্ধে সুরক্ষা) এসব মৌলিক অধিকার পদদলিত হয়েছে। এ ধরনের রাষ্ট্র পরিচালিত বেআইনি কর্মকাণ্ড ‘Constitutional Tort’-এর পর্যায়ে পড়ে এবং রাষ্ট্র এতে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য।
এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাসমূহের প্রেক্ষিতে, আজ বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোঃ মাহমুদুল হাসান সরকারকে একটি আইনি নোটিশ প্রেরণ করেছেন। উক্ত নোটিশটি রেজিস্ট্রি ডাক ও ইমেইলের মাধ্যমে আইন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, পুলিশ মহাপরিদর্শক এবং র্যাব মহাপরিচালকের দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
আরও পড়ুন : প্রয়াত উপদেষ্টা হাসান আরিফের ছেলের বিরুদ্ধে মা-বোনের আইনি নোটিশ
নোটিশে বলা হয়েছে, যারা ‘আয়নাঘর’ এবং অনুরূপ বন্দিশালায় বেআইনিভাবে আটক ছিলেন, তাদের প্রত্যেককে প্রতিদিনের জন্য ১ লক্ষ টাকা হারে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আর যারা সেখানে নির্যাতনে প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের পরিবারকে ১০ কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এই ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য সরকারের বাজেট থেকে ব্যয় না করে, বরং যারা এইসব কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী, সেসব ব্যক্তিদের জব্দকৃত সম্পত্তি ও ব্যাংক হিসাব বাজেয়াপ্ত করে একটি ‘ন্যাশনাল কমপেনসেশন ফান্ড’ (National Compensation Fund) গঠন করার দাবি জানানো হয়েছে।
উল্লেখযোগ্যভাবে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে গঠিত “গুম কমিশন” এইসব ঘটনার তদন্ত করে নিশ্চিত করে যে, ‘আয়নাঘর’ ও অনুরূপ গোপন বন্দিশালাগুলোতে অসংখ্য গুম, বেআইনি আটক, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। কমিশনের প্রতিবেদনে এসব সত্যতা থাকা সত্ত্বেও, বর্তমান সরকার আজও কোনো ক্ষতিপূরণমূলক বা পুনর্বাসনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি, যা “বিচার বিলম্ব মানেই বিচার অস্বীকার” নীতির সরাসরি লঙ্ঘন।
এছাড়াও, নোটিশে দাবি করা হয়েছে, একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিচারিক কমিশন গঠন করতে হবে যারা নির্যাতিত ব্যক্তিদের শনাক্ত করবে, আটককাল নির্ধারণ করবে, ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করবে এবং দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনবে। কমিশনের রিপোর্টটি অবশ্যই সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে এবং তা বাধ্যতামূলকভাবে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
নোটিশে স্পষ্ট করে জানানো হয়েছে যে, উপরোক্ত দাবিসমূহ ১৫ (পনেরো) কার্যদিবসের মধ্যে কার্যকর না হলে, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে জনস্বার্থে রিট আবেদন দায়ের করা হবে।