চেক প্রতারণা সংক্রান্ত এক মামলায় রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ এক গুরুত্বপূর্ণ আইনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আদালত পর্যবেক্ষণ করেছেন— যে কোনো ব্যাংক চেকে প্রাপকের নাম, টাকার অঙ্ক এবং তারিখ উল্লেখ না থাকলে সেটি আইনের চোখে বৈধ চেক নয়। এমনকি ব্ল্যাঙ্ক বা ফাঁকা চেক ইস্যু করা হলেও দাতা আইনগতভাবে উক্ত অঙ্ক প্রদানে বাধ্য থাকবেন না।
১৯ মে ২০২৫ তারিখে বিচারপতি মো. শহরওয়ার্দীর একক বেঞ্চ এ রায় প্রদান করেন। মামলাটি ছিল ক্রিমিনাল আপিল নং-৫৯৩০/২০২৪ (Md. Saiful Islam বনাম The State and another), যা সেশনস কোর্ট, সাতক্ষীরা-২ কর্তৃক প্রদত্ত এক খালাসাদেশের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছিল।
মামলার পটভূমি
অভিযোগকারী মো. সাইফুল ইসলাম দাবি করেন, আসামি মো. আব্দুল মান্নান তার কাছ থেকে ২০১৯ সালের আগস্টে ব্যবসার কাজে ৪৮ লাখ টাকা ঋণ নেন। নির্ধারিত সময়ে টাকা ফেরত না দিয়ে ২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তিনি একটি চেক প্রদান করেন। তবে উক্ত চেক ব্যাংকে উপস্থাপন করলে “insufficient funds” মন্তব্যে তা ফেরত আসে। পরবর্তীতে নোটিশ প্রেরণ করা হলেও আসামি টাকা পরিশোধ করেননি।
আসামির বক্তব্য
ডিফেন্সে দাঁড়িয়ে আসামি আব্দুল মান্নান জানান, তিনি দীর্ঘদিন ব্রিক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন কিন্তু ৫-৭ বছর আগে অবসর নেন এবং শারীরিকভাবে (এক চোখে দৃষ্টিশক্তি হারানো) অসুস্থ। তার দাবি, অভিযোগকারীর পিতা আহমেদ আলীর সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেনের সময় তিনি নিরাপত্তা স্বরূপ কিছু চেক দিয়েছিলেন। ঋণ শোধের পরও ওই চেক ফেরত না দিয়ে অভিযোগকারী ও তার পিতা একটি পুরোনো চেক ব্যবহার করে মিথ্যা মামলা করেছেন।
ট্রায়াল কোর্টের রায়
সাতক্ষীরার যৌথ জেলা ও দায়রা জজ আদালত-২ (সেশন কেস নং-১৮৩৫/২০০০, কালীগঞ্জ) মামলাটি বিচার করে ২০২৪ সালের ২৩ মে মান্নানকে খালাস দেন। আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, অভিযোগকারী টাকার উৎস বা ৪৮ লাখ টাকা নগদে দেওয়ার প্রমাণ দেখাতে পারেননি। এছাড়া অভিযোগকারীর স্বাক্ষ্যেও অসঙ্গতি রয়েছে এবং চেকের লেখার অংশে ভিন্ন হস্তাক্ষরের বিষয়টি নজরে আসে। আদালত মনে করেন, চেকটি আসলে অভিযোগকারীর বাবা আহমেদ আলীর কাছে ব্যবসায়িক লেনদেনের সময় আমানত রাখা হয়েছিল, যা পরে ব্যবহার করে এ মামলা করা হয়।
আপিলে হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ
হাইকোর্ট রায়ে বলেন—
-
৪৮ লাখ টাকার লেনদেনের কোনো দলিল বা উৎস প্রমাণ হাজির করা যায়নি। অভিযোগকারী নিজেও স্বীকার করেছেন যে তিনি ঘরে এত টাকা নগদ রাখতেন না, অথচ কোনো ব্যাংক থেকে উত্তোলনের প্রমাণও দেননি।
-
উপস্থাপিত চেক (এক্সহিবিট-২) পরীক্ষা করে দেখা যায়, আসামির স্বাক্ষর ও অন্য লেখার হাতের লেখা এক নয়। অভিযোগকারীও বলেননি কে বাকি অংশ পূরণ করেছেন।
-
অভিযোগকারী স্বীকার করেছেন যে আসামি শুধু স্বাক্ষর করেছেন, কিন্তু নাম, তারিখ ও টাকার অঙ্ক কে লিখেছে সে সম্পর্কে কিছু বলেননি।
রায়ে আরও উল্লেখ করা হয়—
একটি চেক বৈধ হতে হলে অবশ্যই প্রাপকের নাম, অর্থের পরিমাণ এবং তারিখ উল্লেখ থাকতে হবে। খালি (blank) বা অস্বাক্ষরিত অংশসহ চেক আইনের চোখে চেক নয়। এ ধরনের ব্ল্যাঙ্ক চেক প্রদানের পর আসামিকে অর্থ পরিশোধে বাধ্য করার কোনো আইনি সুযোগ নেই।
নজির স্থাপনকারী মন্তব্য
আদালত A.H. Ershadul Haque vs State, 75 DLR (2023) 447 মামলার নজির উদ্ধৃত করে বলেন—
-
চেক প্রদানের ছয় মাসের মধ্যে তা উপস্থাপন করতে হবে।
-
“Undated cheque” বা “Blank cheque” উপস্থাপনযোগ্য নয়।
-
আইন অনুযায়ী চেকদাতাকে ব্ল্যাঙ্ক চেক সম্মান করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
আপিল খারিজ ও জরিমানা
হাইকোর্ট মনে করেন, অভিযোগকারী সাইফুল ইসলাম প্রকৃত প্রমাণ হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং প্রতিরক্ষার উত্থাপিত যুক্তিগুলো দ্বারা আইনের ১১৮(ক) ধারার প্রাথমিক অনুমান খণ্ডিত হয়েছে। ফলে ট্রায়াল কোর্টের রায় সঠিক হয়েছে।
সব দিক পর্যালোচনা শেষে হাইকোর্ট বলেন, অভিযোগকারী তার পিতার হেফাজতে থাকা পুরোনো চেক ব্যবহার করে মামলা করেছেন। ফলে সেশনস কোর্টের খালাসের রায় বহাল রাখা হয়।
একইসঙ্গে মামলাটি অযৌক্তিকভাবে করার কারণে অভিযোগকারীকে ৫,০০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে, যা ৩০ দিনের মধ্যে ট্রায়াল কোর্টে জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।