হোসাইন মুহাম্মদ ফরাজী
হোসাইন মুহাম্মদ ফরাজী

১০৬ অনুচ্ছেদ সরকারকে বৈধ ঘোষণা করে না

হোসাইন মুহাম্মদ ফরাজী : বাংলাদেশের সংবিধান রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বোচ্চ আইন। এর প্রস্তাবনা ও মূলনীতি স্পষ্ট করে ঘোষণা করে যে, সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ (অনুচ্ছেদ ৭)। সুতরাং সরকার গঠনের প্রশ্নে কেবল আইনগত বৈধতা নয়, রাজনৈতিক বৈধতা ও জনগণের আস্থা এই তিনটি দিক সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

১০৬ অনুচ্ছেদের সীমা

অনেকে প্রায়ই ১০৬ অনুচ্ছেদের প্রসঙ্গ টানেন, যেখানে বলা হয়েছে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের কাছে কোনো আইনি প্রশ্নে মতামত চাইতে পারেন। কিন্তু এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই অনুচ্ছেদ কোনো সরকারকে বৈধ বা অবৈধ ঘোষণা করে না। এটি কেবল একটি reference jurisdiction বা পরামর্শমূলক ক্ষমতা। ফলে সরকার গঠনের বৈধতা নির্ধারণের প্রশ্নে ১০৬ দ্বারা সমাধান হয় না। বৈধতা নির্ভর করে সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক অনুচ্ছেদ ও রাজনৈতিক বাস্তবতার ওপর।

জনগণের অংশগ্রহণের গুরুত্ব

সংবিধানের একাধিক অনুচ্ছেদ সরাসরি জনগণের সার্বভৌমত্ব ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সাথে যুক্ত। জনগণের স্বাধীন মতপ্রকাশ ও ভোটাধিকার ব্যতীত কোনো সরকার প্রকৃত বৈধতা পেতে পারে না।

  • অনুচ্ছেদ ১১ বলছে, প্রজাতন্ত্র গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তিতে চলবে, যেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

  • অনুচ্ছেদ ৫৫(২)-এ বলা হয়েছে, মন্ত্রিসভা জাতীয় সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। কিন্তু যদি সংসদ গঠনের প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তবে সরকারের দায়বদ্ধতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়।

  • একইভাবে অনুচ্ছেদ ৬৫(২) বলছে, জাতীয় সংসদ সরাসরি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হবে। অথচ যখন জনগণের অংশগ্রহণ সীমিত থাকে বা বিরোধী দলসমূহ নির্বাচন বর্জন করে, তখন এই “সরাসরি প্রতিনিধিত্ব” কার্যত ক্ষুণ্ণ হয়।

  • সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো অনুচ্ছেদ ১১৮, যেখানে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। কমিশন যদি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, তবে পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বৈধতা ক্ষুণ্ণ হয়।

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও তুলনা

এই সংকট শুধু বাংলাদেশের নয়। অন্যান্য দেশেও এমন উদাহরণ রয়েছে। পাকিস্তানে বহুবার আদালত doctrine of necessity ব্যবহার করে সামরিক শাসনকে বৈধতা দিয়েছে। নেপালে সাংবিধানিক কাঠামো অক্ষুণ্ণ থাকলেও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে একাধিক সরকার পতন হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় নির্বাচনী বৈধতা সংকট তৈরি হলে বড় ধরনের সাংবিধানিক সংস্কার চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব উদাহরণ স্পষ্ট করে যে, আইনের অপপ্রয়োগ দিয়ে সরকার টিকিয়ে রাখা গেলেও জনগণের আস্থা ছাড়া সেটি স্থায়ী হয় না।

কার্যকর প্রশাসন ও বৈধতা

তদুপরি, কেবল সরকার গঠনই যথেষ্ট নয়, কার্যকর প্রশাসন ও জনআস্থা অর্জনের মধ্য দিয়েই একটি সরকারের বৈধতা সুসংহত হয়। আইনগত কাঠামোর আড়ালে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতাই বৈধতার সংকটকে আরও প্রকট করে তুলে।

উপসংহার

বাংলাদেশের সংবিধান স্পষ্ট করে বলেছে, জনগণই রাষ্ট্রের মালিক। ১০৬ অনুচ্ছেদ কোনো সরকারের বৈধতা নির্ধারণ করে না। বরং ৭, ১১, ৫৫, ৬৫ ও ১১৮ অনুচ্ছেদ একত্রে গণতন্ত্র, অংশগ্রহণমূলক সরকার ও জনগণের সার্বভৌমত্বকে নিশ্চিত করে। ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা আমাদের শেখায়, সংবিধানের অক্ষর নয়, বরং ইহার আত্মরক্ষা করাই সরকার বৈধতার আসল মাপকাঠি।

লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, ঢাকা।