মাসুদুর রহমান : বাংলাদেশের ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থায় ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮ -এর ১৬৪ ধারা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধান হিসেবে বিবেচিত। এ ধারার অধীনে একজন বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে অভিযুক্ত ব্যক্তির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি বা কোনো সাক্ষীর বিবৃতি রেকর্ড করা হয়, যা পরবর্তীতে আদালতে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই ধারার মূল উদ্দেশ্য হলো পুলিশি প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষ পরিবেশে অভিযুক্ত বা সাক্ষীর বক্তব্য সংরক্ষণ করা, যাতে তা পরবর্তীতে সহজে প্রত্যাহার করা না যায়।
একটি স্বেচ্ছায় প্রদত্ত স্বীকারোক্তি প্রমাণ হিসেবে অত্যন্ত শক্তিশালী এবং অনেক ক্ষেত্রে মামলার নিষ্পত্তি দ্রুততর করতে সহায়ক হয়। তবে বাস্তবে এই প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও অভিযুক্তের অধিকার রক্ষার প্রশ্নে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক রয়েছে। সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হলো, এই ধরনের জবানবন্দি গ্রহণের সময় আইনজীবীর উপস্থিতি কি বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত কিনা। বর্তমানে আইনে এ বিষয়ে কোনো স্পষ্ট বিধান নেই, যা অভিযুক্তের মৌলিক অধিকার সুরক্ষায় একটি বড় শূন্যতা তৈরি করেছে।
১৬৪ ধারার অধীনে জবানবন্দি রেকর্ড করার ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটকে কিছু শর্ত মেনে চলতে হয়। যেমন অভিযুক্তকে জানাতে হয় যে তিনি স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য নন, স্বীকারোক্তি দিলে তা তার বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার হতে পারে, এবং তাকে চিন্তা করার জন্য পর্যাপ্ত সময় দিতে হয়। এছাড়া ম্যাজিস্ট্রেটকে লিখিতভাবে প্রত্যয়ন করতে হয় যে, জবানবন্দি স্বেচ্ছায় দেওয়া হয়েছে। এসব ব্যবস্থার উদ্দেশ্য অভিযুক্তের অধিকার রক্ষা করা হলেও বাস্তবে এর কার্যকারিতা প্রায়শই প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
পুলিশ হেফাজতে দীর্ঘ সময় কাটানোর পর অভিযুক্ত মানসিক ও শারীরিক চাপে থাকেন, ফলে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে তিনি স্বাধীনভাবে বক্তব্য দিতে পারেন না। নিরক্ষর বা আইনি অজ্ঞ ব্যক্তিরা তো একেবারেই বুঝতে পারেন না যে তার নীরব থাকার অধিকার আছে। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রে জবানবন্দি প্রকৃত অর্থে স্বেচ্ছায় না হলেও কাগজে-কলমে সেটিকে স্বেচ্ছামূলক হিসেবে রেকর্ড করা হয়, যা ন্যায়বিচারকে ব্যাহত করে।
আইনজীবীর উপস্থিতির পক্ষে যুক্তি
আইনজীবীর উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করার পক্ষে অসংখ্য যুক্তি বিদ্যমান, যা ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের মৌলিক নীতির সাথে সম্পর্কিত। প্রথমত এবং প্রধানত, এটি অভিযুক্তের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা করে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫(৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তিকে তার নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না। একজন আইনজীবীর উপস্থিতি নিশ্চিত করে যে, অভিযুক্তকে তার নীরব থাকার অধিকার সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে অবহিত করা হয়েছে এবং তিনি যেন কোনো চাপ বা প্রলোভনের শিকার না হন।
দ্বিতীয়ত, আইনজীবীর উপস্থিতি পুলিশি প্রভাবমুক্ত একটি পরিবেশ নিশ্চিত করে। যদিও ১৬৪ ধারার জবানবন্দি ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে রেকর্ড করা হয়, তবে এর আগে অভিযুক্ত দীর্ঘ সময় ধরে পুলিশ হেফাজতে থাকে। একজন আইনজীবী উপস্থিত থাকলে পুলিশ বা অন্য কোনো প্রভাব বিস্তারকারী মহলের পক্ষে অভিযুক্তের ওপর চাপ প্রয়োগ করা কঠিন হয়ে যায়। তৃতীয়ত, আইনজীবীর পরামর্শ ছাড়া একজন অভিযুক্ত তার স্বীকারোক্তির সম্ভাব্য আইনগত পরিণতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ থাকেন।
একজন আইনজীবী তাকে বোঝাতে পারেন যে, একটি স্বীকারোক্তি কীভাবে তার মামলার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে এবং এর বিকল্প কী হতে পারে। এটি অভিযুক্তকে একটি তথ্যসমৃদ্ধ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। চতুর্থত, এটি একটি ন্যায্য বিচার প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের বিচার ব্যবস্থায় ‘প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক ব্যক্তি নিরপরাধ’ (Innocent until proven guilty) এই মূলনীতি অনুসরণ করা হয়। আইনজীবীর উপস্থিতি এই নীতিকে আরও শক্তিশালী করে এবং নিশ্চিত করে যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি কোনো প্রকার ফাঁদে না পড়ে তার আইনি অধিকারের পূর্ণ সুযোগ পায়।
আইনজীবীর উপস্থিতির বিরুদ্ধে যুক্তি ও তার খণ্ডন
প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে একটি সাধারণ যুক্তি হচ্ছে- যদি আইনজীবী ১৬৪ ধারার সময় উপস্থিত থাকে, তাহলে অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রায়ই জবানবন্দি দেবে না, ফলে তদন্ত ব্যাহত হবে। এই যুক্তির পেছনে আংশিক বাস্তবতা থাকলেও, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং নিরীহ ব্যক্তির অধিকার রক্ষা করাই আইন ও সংবিধানের মূল উদ্দেশ্য। অপরাধ স্বীকার করানো পুলিশের উদ্দেশ্য হতে পারে, কিন্তু সেটি যদি চাপ, প্রলোভন বা নির্যাতনের মাধ্যমে হয়, তাহলে তা সংবিধানবিরোধী এবং অন্যায়।
প্রকৃত অপরাধীকে চিহ্নিত করার জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক তদন্ত, ফরেনসিক প্রযুক্তি, সিসিটিভি ফুটেজ এবং সাক্ষ্যপ্রমাণ ব্যবহারের মাধ্যমে সত্য উদঘাটন করা উচিত, শুধু জবানবন্দির ওপর নির্ভর না করে। অতএব, আইনজীবীর উপস্থিতিতে সুষ্ঠু ও স্বতঃস্ফূর্ত জবানবন্দি আদায় হলে তা আদালতের কাছেও আরও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।
মামলার আলোকে ১৬৪ ধারার অপব্যবহার
কেরানীগঞ্জ মামলা (২০২৩)
ঢাকার কেরানীগঞ্জে এক যুবককে হত্যা করার অভিযোগে একজন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরবর্তীতে পুলিশ জানায়, সে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে যে সে তার বন্ধুকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু ১৫ দিন পর ওই “মৃত ব্যক্তি” জীবিত অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসে। এতে স্পষ্ট হয়—পুলিশ জবানবন্দি আদায়ে জোরপূর্বক বা প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল। এই মামলায় পুলিশের বিরুদ্ধে জবানবন্দি তৈরির অভিযোগ ওঠে এবং তা দেশের মিডিয়া ও মানবাধিকার মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
নারায়ণগঞ্জ মামলা (২০২০)
২০২০ সালের ৪ জুলাই পঞ্চম শ্রেণির একজন ছাত্রী নিখোঁজ হয়। এরপর ৬ আগস্ট ওই ছাত্রীর বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় অপহরণ মামলা দায়ের করেন। মামলার পর পুলিশ আব্দুল্লাহ, রকিব এবং খলিল নামে ৩ জনকে গ্রেপ্তার করে। তিন আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন। আসামিরা স্বীকারোক্তিতে বলেন যে, তারা ওই ছাত্রীকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ২৩ আগস্ট ওই ছাত্রী ফিরে আসে। আসামীদের স্বজনরা জানিয়েছেন, পুলিশ নির্যাতন করে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করেছে।
নুসরাত হত্যা মামলা (২০১৯)
২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি-কে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা সারাদেশকে নাড়া দিয়েছিল। এই মামলাটি বাংলাদেশের বিচার ইতিহাসে এক আলোচিত ও তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। ঘটনার পরপরই অভিযুক্তদেরকে গ্রেফতার করে পুলিশ দ্রুত সময়ের মধ্যে আদালতে হাজির করে এবং তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে ১৬৪ ধারার অধীনে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়।
তবে এই জবানবন্দিগুলো আদায় প্রক্রিয়া নিয়ে তখন একাধিক প্রশ্ন উঠে আসে। অভিযুক্তদের পরিবার এবং কিছু মানবাধিকার সংগঠন দাবি করে যে, পুলিশ হেফাজতে মানসিক চাপ, নির্যাতন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে এসব স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়। এমনকি কিছু আইনজীবী ও পর্যবেক্ষক বলেন, জবানবন্দি দেওয়ার আগে অভিযুক্তদের যথাযথ আইনি সহায়তা বা আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শের সুযোগও দেওয়া হয়নি। ফলে এই স্বীকারোক্তিগুলো স্বতঃস্ফূর্ত না হয়ে বরং বাধ্যতামূলক ছিল কিনা, সেই প্রশ্ন ওঠে।
সমাধানের উপায়
১৬৪ ধারার জবানবন্দি গ্রহণের সময় আইনজীবীর উপস্থিতি বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত কিনা, এই বিতর্কটি কেবল একটি আইনি প্রশ্ন নয়, এটি ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং একটি সভ্য সমাজের প্রতিশ্রুতির সাথে সম্পর্কিত। যদিও বিদ্যমান আইনে এর কোনো সুস্পষ্ট বাধ্যবাধকতা নেই, তবে উপরের আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আইনজীবীর উপস্থিতি অপরিহার্য।
এটি অভিযুক্তের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে, পুলিশি জবরদস্তি প্রতিরোধ করে এবং জবানবন্দিকে সত্যিকার অর্থেই স্বেচ্ছামূলক করে তোলে। বর্তমান আইনি কাঠামোতে যে দুর্বলতাগুলো রয়েছে, তা দূর করার জন্য অবিলম্বে সংস্কার প্রয়োজন। এই বিষয়ে কয়েকটি সুপারিশ করা যেতে পারে।
প্রথমত, ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮ -এর ১৬৪ ধারায় একটি সংশোধনী আনা যেতে পারে, যা সুস্পষ্টভাবে একজন অভিযুক্তের জন্য একজন আইনজীবীর উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করবে এবং আইনজীবীর উপস্থিতিতে ভিডিও রেকর্ডিং চালু করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, যতক্ষণ না আইন সংশোধন করা হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের একটি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের মাধ্যমে একটি দিকনির্দেশনা (guideline) জারি করা যেতে পারে, যা সকল ম্যাজিস্ট্রেটকে ১৬৪ ধারার জবানবন্দি গ্রহণের সময় অভিযুক্তকে আইনি সহায়তার সুযোগ দিতে বাধ্য করবে।
তৃতীয়ত, সরকারকে লিগ্যাল এইড ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে কোনো দরিদ্র বা আর্থিকভাবে অসচ্ছল ব্যক্তি আইনি প্রতিনিধিত্বের অভাবে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়।
পরিশেষে বলা যায়, বিচার শুধু আইন প্রয়োগ নয়, বরং তা ন্যায়, মানবতা এবং আত্মিক শান্তির প্রতিফলন। একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি আদালতে দোষ স্বীকার করলে সেটি তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে , হয়তো তাকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। এমন একটি গুরুতর প্রক্রিয়ায় যদি তার পাশে একজন আইনজীবী না থাকেন, তবে সেই স্বীকারোক্তি আদৌ কতটা স্বতঃস্ফূর্ত, নিরপেক্ষ ও সত্য, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই ন্যায্য।
একটি সুষ্ঠু ও ন্যায়ভিত্তিক বিচার ব্যবস্থা কেবল তখনই সম্ভব, যখন প্রতিটি ব্যক্তি তার আইনি অধিকার সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে সচেতন থাকে এবং তা প্রয়োগের সুযোগ পায়। ১৬৪ ধারার জবানবন্দি গ্রহণের সময় একজন আইনজীবীর উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করার মাধ্যমে আমরা সেই লক্ষ্য পূরণের দিকে এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারব।
লেখক : মাসুদুর রহমান; আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। E-Mail : masud.law22@gmail.com