দীর্ঘদিন ধরে নিজের ও স্ত্রী-আন্তরার নামে বিভিন্ন ব্যাংকে স্থায়ী আমানত (এফডিআর) রেখে আসা এক করদাতা নিয়মিতভাবে জুনের শেষের কর্মদিবসের আগেই সব এফডিআর ভেঙে টাকা পে-অর্ডার আকারে তুলে নেওয়ার মাধ্যমে আয় গোপন করে কর ফাঁকি দিচ্ছেন, এমন গোপন সূত্র ও এনবিআর-র গোয়েন্দা তদন্তে (আইটিআইআইইউ) পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সন্দেহভাজন ব্যক্তি হচ্ছেন নিরঞ্জন ঘোষ। তিনি একজন আয়কর আইনজীবী ও অ্যাক্সেসরিজ ব্যবসায়ী এবং রাজধানীর খিলগাঁওয়ে বসবাস করেন।
জানা গেছে, মেয়াদ পূর্ণ হোক বা না হোক ৩০ জুনের আগেই এফডিআর ভেঙে টাকা তুলে নিয়ে পরে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে নতুন এফডিআর করা হচ্ছিল। উদাহরণস্বরূপ, গত ৩০ জুনের আগে শুধুমাত্র নিজের নামে পৌনে ৯ কোটি টাকার এফডিআর ভেঙে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে ১১ কোটি টাকার বেশি এফডিআর করা হয়েছে। এনবিআর গোয়েন্দারা ধারণা করছেন, বছরের পর বছর এই পদ্ধতিতে তিনি আয় গোপন রেখে কর থেকে পলায়ন করছিলেন।
রাজস্ব গোয়েন্দারা বলছেন, যদি নিরঞ্জন ঘোষ তার এফডিআর-সমূহকে অর্থ আয় হিসেবে দেখাতেন, তাহলে নিয়মিত করহার অনুযায়ী ২৫ শতাংশ কর ধার্য হতো। আইটিআইআইইউর প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, তিনি কমপক্ষে সাড়ে তিন কোটি টাকার মতো কর ফাঁকি দিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমনও সম্ভাবনা আছে যে, যে উৎস থেকে এত বড় অঙ্কের এফডিআর হচ্ছে, তা বৈধ আয় নয় এবং তিনি উৎস দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
আরও পড়ুন : কুড়িগ্রাম আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে ১৯ পদের ১৮টিতে বিএনপির জয়
ইতোমধ্যেই নিরঞ্জন ঘোষ ও তাঁর স্ত্রীর সব ব্যাংক হিসাব স্থগিত (ফ্রিজ) করা হয়েছে এবং ব্যাঙ্কগুলোকে তাদের আয়, সম্পদ ও লেনদেন যাচাই করার জন্য বিভিন্ন তথ্য চাওয়া হয়েছে।
এনবিআর-সংযুক্ত কর্মকর্তারা জানান, আয় গোপন করে কর ফাঁকি দিতেই নিরঞ্জন ঘোষ প্রতিবছর জুন শেষের কর্মদিবসের আগেই এফডিআর ভাঙছেন, যাতে আয়বর্ষের শেষ দিনে সেই অর্থ ব্যাংকের হিসাব হিসেবে উপস্থিত না থাকে। একজন আয়কর আইনজীবী হওয়ায় তিনি কিভাবে ফাঁকির পথ অবলম্বন করতে হয় তা বোঝেন—এটাই তাদের অভিযোগ। ফাঁকি দিতে গিয়ে রিটার্নের সম্পদ বিবরণীতে পে-অর্ডার আকারে থাকা অর্থও প্রদর্শন করা হচ্ছে না। এফডিআর ভাঙানোর সময় ব্যাংক উৎসে ১০ শতাংশ কর কেটে নেওয়া থাকলেও, চূড়ান্ত কর নির্ধারণের সময় সেই করের সমন্বয়ের দাবি তিনি করেন না—কারণ আয় গোপন রাখলে তাঁর লাভ বেশি হয়।
কিভাবে ধরা পড়লেন নিরঞ্জন ঘোষ
গোপন সূত্রে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নিরঞ্জন ঘোষ ও তাঁর স্ত্রী অন্তরা ঘোষের সর্বশেষ ২০২৪-২৫ করবর্ষের রিটার্ন যাচাই করা হলে দেখা যায় নিরঞ্জন ঘোষ নামমাত্র ব্যক্তিগত আয় দেখিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি মৎস্য খাত ও ব্যবসা থেকেও নামমাত্র আয় দেখিয়েছেন এবং রিটার্নে তিনি তিন কোটি ১৩ লাখ টাকার নিট সম্পদ দেখিয়েছেন। ব্যাংক হিসাবের ব্যালান্স ‘শূন্য’ দেখানোর ফলে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সন্দেহ জাগে।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন মাসের শেষ সপ্তাহে সাউথইস্ট ব্যাংক কাকরাইল শাখায় তিনি চারটি এফডিআর ভেঙে সুদসহ প্রায় ৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকার পে-অর্ডার নেন। এতে তাঁর ব্যালান্স শূন্য হয়ে যায়। একই সঙ্গে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের একটি শাখায় একটি এফডিআর ভাঙে সুদসহ ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকার পে-অর্ডার তিনি নেন। কিন্তু সর্বশেষ করবর্ষের রিটার্নে এফডিআরের বিষয় উল্লেখ করা হয়নি।
এরপরে, গত ৭ জুলাই নিরঞ্জন ঘোষ সাউথইস্ট ব্যাংক করপোরেট শাখায় মোট ১১ কোটি ১৪ লাখ ৯২ হাজার টাকার ১২টি এফডিআর করেন। অর্থাৎ কাকরাইল শাখা ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকে জুনের শেষ সপ্তাহে ভাঙে নেয়া পে-অর্ডারের টাকার সঙ্গে আরও প্রায় ২ কোটি ৩৪ লাখ ৯২ হাজার টাকা যোগ করে মোট ১১ কোটি ১৪ লাখ ৯২ হাজার টাকার এফডিআর করা হয়েছে, যা আয়কর আইনের দিক থেকে অপ্রদর্শিত আয় হিসেবে গণ্য হবে।
আরও পড়ুন : জজকোর্টের একটি অদ্ভুত সংস্কৃতি “আদেশ হবে”
আইটিআইআইইউর প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, এই অর্থের ওপর ২৫ শতাংশ হারে প্রযোজ্য কর হবে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা; জরিমানাসহ তা প্রায় চার কোটি টাকা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। তিনি ২০২৩-২৪ আয়বর্ষে রিটার্নে আয় দেখিয়েছেন ৩২ লাখ ৬৫ হাজার ১০৭ টাকা এবং এর বিপরীতে আয়কর হিসেবে দিয়েছেন ৫ লাখ ৮৫ হাজার ৮৫২ টাকা। এ ছাড়া রিটার্নে মৎস্য খাতে যে আয় দেখানো হয়েছে, তার সপক্ষে কোন প্রমাণই পাওয়া যায়নি। পেঁয়াজ আমদানি করার জন্য অনুমতিপত্র নেওয়ার কথাও রেকর্ডে আছে; কিন্তু রিটার্নে পেঁয়াজ ব্যবসার বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শুধু ২০২৪-২৫ করবর্ষই না, নিরঞ্জন ঘোষ ও তাঁর স্ত্রী অন্তরা ঘোষ আগের পাঁচটি করবর্ষেও একই পদ্ধতিতে ব্যাংক হিসাবের ব্যালান্স শূন্য দেখিয়ে আসছেন। মোট ছয় করবর্ষের রিটার্ন যাচাই করা হচ্ছে। নিরঞ্জন ঘোষ খিলগাঁও এলাকায় এএএ প্লাস অ্যাক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালান; তিনি ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে রিটার্নে আয় দেখিয়েছেন প্রায় ৭ লাখ ৭৩ হাজার টাকা।
নিরঞ্জন ঘোষের বক্তব্য
নিরঞ্জন ঘোষের মোবাইল ফোনে কল করে অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি প্রথমেই পাল্টা প্রশ্ন করেন, এফডিআরের মূলধনের ওপর কেন কর দিতে হবে? তিনি বলেন, এফডিআর যে কোনো সময় নগদায়ন করা বৈধ। তদুপরি যে পরিমাণ টাকার কথা এনবিআর বলছে, প্রকৃতপক্ষে তাঁর মতে এত টাকার এফডিআর নেই। এই এফডিআরের ব্যাখ্যা ও কর দিতে হবে পরবর্তী করবর্ষে, এবং ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত কর পরিশোধের সময়ও আছে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমি পেঁয়াজ আমদানির জন্য অনুমতি নিয়ে রেখেছি। কিন্তু ব্যাংক হিসাব বন্ধ করে রাখায় পণ্য আমদানি করতে পারছি না। এভাবে ব্যবসা আটকে রাখা এখতিয়ার-বহির্ভূত কাজ। ব্যবসা চালু না থাকলে দেবেন কীভাবে’, এমন প্রশ্নও করেছেন।
আইটিআইআইইউ কমিশনারের মন্তব্য
আইটিআইআইইউ’র কমিশনার মোহাম্মদ আবদুর রকিব এ বিষয়ে বলেন, রিটার্নে এফডিআর দেখানো নেই। ৩০ জুনের আগে এফডিআর ভেঙে ‘ব্যালান্স শূন্য’ করা হয়েছে এবং ৩০ জুনের পর আবার সেই টাকা এফডিআর করা হয়েছে। রিটার্নে ব্যালান্স শূন্য দেখিয়ে কর ফাঁকি দিতে অপকৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে, একজন আইনজীবীর কাছ থেকে এমন আচরণ আশা করা যায় না।
তিনি বলেন, কর ফাঁকির এই কৌশল সামনে আসার পর আমরা করদাতাদের রিটার্ন যাচাইয়ে আরও সতর্ক হব। তাদের ধারণা যে অনেক করদাতা ৩০ জুনের আগে এই ধরনের কাজ করে কর ফাঁকি দিচ্ছেন।
এনবিআর ও আইটিআইআইইউ সূত্র জানায়, নিরঞ্জন ঘোষ ও তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব স্থগিত করে এবং ব্যাঙ্কিং লেনদেন, আয় ও সম্পদ সংক্রান্ত তথ্য ব্যাংকগুলোকে চেয়ে নেওয়া হয়েছে, যার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী আইনগত ও রাজস্ব ব্যবস্থাসমূহ অনুসরণ করা হবে।
সূত্র : সমকাল