কারাগারে নেওয়ার জন্য প্রিজন ভ্যানে মা শাহাজাদী ও তাঁর ১১ দিন বয়সী নবজাতক। রোববার আদালত প্রাঙ্গণে
কারাগারে নেওয়ার জন্য প্রিজন ভ্যানে মা শাহাজাদী ও তাঁর ১১ দিন বয়সী নবজাতক। রোববার আদালত প্রাঙ্গণে

১১ দিনের শিশুসহ মা কারাগারে

ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা ৩টা ২৪ মিনিট। আদালতকক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে প্রিজন ভ্যান। পুলিশের পাহারায় একে একে আসামিরা উঠছেন ভ্যানে। সেই মুহূর্তে এক নারী পুলিশ সদস্যের হাত ধরে আছেন আসামি শাহাজাদী। চোখে পানি, মুখে অসহায়ত্বের ছাপ। আরেক পুলিশ সদস্যের কোলে ছোট্ট কাঁথায় মোড়ানো শাহাজাদীর ১১ দিনের নবজাতক। একদম চুপচাপ। ভ্যানে ওঠার পর শিশুটিকে মায়ের কোলে দেওয়া হয়। কয়েক মুহূর্ত পর খুলনা জেলা কারাগারের উদ্দেশে রওনা দেয় ভ্যান। মা ও তার ১১ দিনের শিশুর একসঙ্গে কারাগারে যাত্রা শুরু হয়।

সাত দিন ধরে নগরের একটি হাসপাতালের কক্ষে মায়ের সঙ্গেই ছিল নবজাতক। গতকাল রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) মা-সন্তান দুজনকে একসঙ্গে পাঠানো হলো কারাগারে।

শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় গ্রেপ্তার শাহজাদীকে হাসপাতাল থেকে আদালতে পাঠায় পুলিশ। এদিন খুলনার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে তাঁর পক্ষে কেউ জামিন আবেদন করেননি। ছিলেন না কোনো আইনজীবী। তাই শুনানিও হয়নি। পরে আদালত শাহজাদীকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ১১ দিন বয়সী কন্যাশিশুকে দেখাশোনা করার কেউ না থাকায় শাহজাদীর সঙ্গে তাঁকেও খুলনা জেলা কারাগারে নিয়ে যায় পুলিশ। মায়ের সঙ্গে শিশুকে কারাগারে যেতে দেখে আদালতে উপস্থিত অনেককেই চোখ মুছতে দেখা যায়।

খুলনা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে কর্মরত প্রসিকিউশন বিভাগের এসআই বোধন চন্দ্র বিশ্বাস (জিআরও-সদর) জানান, আদালতে শাহজাদীর পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না। কেউ জামিন আবেদনও করেননি। আদালত আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। নবজাতকের বিষয়টি পৃথকভাবে কেউ আদালতকে উত্থাপন করেনি। প্রথা অনুযায়ী মায়ের সঙ্গেই তাকে থাকতে দেওয়া হয়েছে।

ঘটনার শুরু ১১ সেপ্টেম্বর। খুলনার রূপসা এলাকার একটি হাসপাতালে বাগেরহাটের রামপালের সিরাজুল ইসলাম ও ফকিরহাটের মেয়ে শাহাজাদীর (৩৬) ঘরে জন্ম নেয় ফুটফুটে কন্যাশিশু। তাঁদের ঘরে এর আগে চার মেয়ে রয়েছে। এবার অন্তত ছেলে সন্তান হবে—এমন প্রত্যাশা করেছিলেন স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন। কিন্তু এমন অবস্থায় গত ১১ সেপ্টেম্বর রাতে সিজারিয়ানের মাধ্যমে ফুটফুটে কন্যাসন্তান জন্ম দেন শাহজাদী। কন্যাশিশু জন্ম নেওয়ায় স্বামী সিরাজুল স্ত্রীকে হাসপাতালে ফেলে চলে যান। এরপর আর খবর নেননি।

আরও পড়ুনজমি কিনেছেন দাগে দাগে কিন্তু ভোগদখল একদাগে- আইনি সমাধান কী?

পরিবারের চাপ আর হতাশার মধ্যে ১৫ সেপ্টেম্বর ঘটে চাঞ্চল্যকর ঘটনা। একই হাসপাতাল থেকে চুরি হয় আরেক প্রসূতির চার দিনের ছেলে নবজাতক। তবে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সিসিটিভি ফুটেজ ও পুলিশের তৎপরতায় উদ্ধার হয় নবজাতক। উদ্ধার করা হয় শাহাজাদীর মা নার্গিস বেগমের (৫৫) কাছ থেকে। তখন আটক হন তিনি। পুলিশকে তিনি জানান, মেয়ের সংসার বাঁচাতেই এমন কাজ করেছিলেন।

চুরি যাওয়া শিশুর বাবা মো. মির্জা সুজন মানব পাচার আইনে মামলা করেন। মামলায় আসামি করা হয় শাহাজাদীর মা ও তাঁকে। ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে নার্গিস বেগমকে কারাগারে পাঠানো হয়। গত ছয় দিন ধরে তিনি কারাগারে। আর শাহজাদী হাসপাতালের একটি কক্ষে পুলিশ প্রহরায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। গতকাল আদালতে তোলার পর অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. ইনামুল হক বলেন, ১০ সেপ্টেম্বর শিশুর বাবা ও মামা রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন এবং ২ হাজার টাকা জমা দেন। পরদিন সিজারিয়ানের মাধ্যমে জন্ম হয় কন্যাসন্তানের। জন্মের পর থেকেই বাবা সিরাজুল আর আসেননি। রবিবার শিশুর মামা বকেয়া বিল পরিশোধ করেন। দুপুরে পুলিশের প্রহরায় মা-সন্তানকে আদালতে নেওয়া হয়।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সদর থানার এসআই শাহীন বলেন, আসামিরা হাতেনাতে ধরা পড়েছেন এবং চুরি যাওয়া শিশু উদ্ধার হয়েছে। চুরি হওয়া শিশুর বাবা মানব পাচার আইনে মামলা করেছেন। আসামি সুস্থ হওয়ায় আইন মেনে তাঁকে আদালতে তোলা হয়। আদালতের নির্দেশে মা ও শিশুকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

মামলা চালাতে চান না বাদী

তবে বাদী মির্জা সুজন মামলা চালাতে আগ্রহী নন। তিনি বলেন, “আমি যদি মামলাটা ধরে রাখি, তাহলে বারবার খুলনায় আসতে হবে, যা সম্ভব নয়। আমার ছোট চাকরি, আর্থিক কষ্টও আছে। সেই মা-ও কষ্টে আছেন। আমার সন্তান জন্মের পর বুকের দুধ পাচ্ছিল না। তখন ওই নারীই আমার সন্তানকে বুকের দুধ খাইয়েছেন। এই বিবেচনায় আমি মামলাটা এগিয়ে নিতে চাই না।”

তিনি আরও বলেন, “আমি বাচ্চা ফিরে পাওয়ার পর জানিয়েছিলাম আমার আর অভিযোগ নেই। কিন্তু পুলিশই মামলা করেছে। আমি চাই না এটা আর এগিয়ে যাক।”

এসআই শাহীন অবশ্য এ দাবি নাকচ করেন। তিনি বলেন, “বাদীর এই বক্তব্য মিথ্যা। তিনি মামলা করতে না চাইলে পুলিশ জোর করে মামলা করতে পারে নাকি?”