আজ (২২ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট হতে সারাদেশে বিশেষায়িত বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। দেশের বাণিজ্যিক বিরোধসমূহ দ্রুত ও কার্যকরভাবে নিষ্পত্তির মাধ্যমে বিনিয়োগ পরিবেশকে আরও গতিশীল ও স্বচ্ছ করে তুলতে এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে এর মাধ্যমে দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি পাবে এবং সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে।
প্রস্তাবে ব্যবসায়ী, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বণিকদের সাধারণ লেনদেন থেকে শুরু করে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম, বিমান ও নৌপরিবহন, নির্মাণ ও অবকাঠামোগত প্রকল্প, ফ্র্যাঞ্চাইজ চুক্তি, বিতরণ ও লাইসেন্সিং, প্রযুক্তি উন্নয়ন, ট্রেডমার্ক, কপিরাইট, পেটেন্ট, শিল্প নকশা, ডোমেইন নাম, ভৌগলিক নির্দেশক, বীমা এবং অংশীদারিত্ব চুক্তি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পরিষেবা খাত এবং শেয়ারহোল্ডার বা যৌথ উদ্যোগ সম্পর্কিত বিরোধকে বিশেষায়িত বাণিজ্যিক আদালতের এখতিয়ারভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। আশা করা যায় এর ফলে আধুনিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্কিত প্রায় সব ধরনের বিরোধ একটি বিশেষায়িত আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তির সুযোগ সৃষ্টি হবে।
প্রেরিত প্রস্তাবে জেলা জজদের মধ্য থেকে বাণিজ্যিক আদালতের বিচারক নিয়োগ করার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। একই সঙ্গে প্রধান বিচারপতি কর্তৃক হাইকোর্ট বিভাগে বাণিজ্যিক আপীল বেঞ্চ গঠনের বিষয়টিও প্রস্তাবে উঠে এসেছে। সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক প্রেরিত প্রস্তাবে মামলা দায়েরের পূর্বে মধ্যস্থতাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আশা করা যায় এর ফলে মামলা দায়েরের পূর্বেই অনেক বিরোধ আদালতের বাইরে নিষ্পত্তি হবে এবং এর ফলে আদালতের উপর মামলার ক্রমবর্ধমান চাপ অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
প্রস্তাবে উল্লেখ রয়েছে যে, কোনো বাণিজ্যিক মামলা বা আবেদন এর মূল্যমান ৫০ লক্ষ টাকা হলে তা বাণিজ্যিক আদালতে বিচার্য হবে। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী সরকার সময়ে সময়ে এই নির্ধারিত মূল্যমান সীমা পুনঃনির্ধারণ করতে পারবে মর্মে প্রস্তাবে উল্লেখ রয়েছে।
আরও পড়ুন : প্রধান বিচারপতির রোডম্যাপ ঘোষণার একবছর: বাস্তবায়ন শতভাগের কাছাকাছি
বিচার প্রক্রিয়াকে দ্রুত ও কার্যকর করার জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বিচার কার্যক্রম শেষ করার বিষয়ে প্রস্তাবে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। প্রস্তাবে উল্লেখ রয়েছে যে চূড়ান্ত শুনানি অবশ্যই ৯০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। এছাড়া, অপ্রয়োজনীয় বিলম্ব এড়াতে সংক্ষিপ্ত বিচারের সুযোগও প্রস্তাবে রাখা হয়েছে। আপীল নিষ্পত্তির ক্ষেত্রেও সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাণিজ্যিক আপীল আদালত ছয় মাসের মধ্যে এবং সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ তিন মাসের মধ্যে আপীল নিষ্পত্তির প্রচেষ্টা গ্রহণ করবে প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া, প্রস্তাবে বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠা ও কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন, বিচারক ও আইনজীবীদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং ধারাবাহিক পেশাগত উন্নয়নের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, প্রস্তাবটি প্রেরণের পূর্বে বিভিন্ন অংশীজনদের মতামত গ্রহণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে, বিগত ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ খ্রি., ৫ এপ্রিল ২০২৫ খ্রি. ও ১২ এপ্রিল ২০২৫ খ্রি. তারিখে যথাক্রমে ময়মনসিংহ, রংপুর ও খুলনায় বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ও UNDP এর যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘Judicial Independence and Efficiency in Bangladesh’ শীর্ষক রিজিওনাল সেমিনারসমূহে বিচারক, আইনজীবী, উন্নয়ন সহযোগীসহ অন্যান্য অংশীজনদের সমন্বয়ে পৃথক তিনটি সেশনে দেশে বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠায় করণীয় সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হয়।
এছাড়া, বিগত ২১ জুলাই ২০২৫ খ্রি. তারিখে UNDP ও Bangladesh Investment Development Authority (BIDA) এর যৌথ উদ্যোগে রাজধানীর BIDA মিলনায়তনে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে অপর একটি সেমিনার আয়োজন করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৭ আগস্ট ২০২৫ খ্রি. তারিখ বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ও UNDP এর যৌথ উদ্যোগে সিলেটে বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠায় করণীয় সম্পর্কে একটি বিশেষ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সেমিনারের Technical ও Plenary Session-এ বিভিন্ন শ্রেণীর অংশীজনগণ বাণিজ্যিক আদালত সম্পর্কে তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেন। উক্ত মতামতসমূহ বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তাবটি চূড়ান্ত করা হয়।
দেশে পৃথক বাণিজ্যিক আদালত তৈরি হলে তা বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করবে। বিশেষায়িত আদালতের মাধ্যমে দ্রুত বিচারপ্রাপ্তির ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে এবং অর্থনীতির গতি আরও ত্বরান্বিত হবে বলে সংশ্লিষ্ট মহল দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে।