পৃথক সুপ্রীম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠার ভিত্তি প্রায় সম্পূর্ণ : প্রধান বিচারপতি

বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক পৃথকীকরণ প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, একটি পৃথক সুপ্রীম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠার ভিত্তি প্রায় সম্পূর্ণ। অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের সক্রিয় সহযোগিতা ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী আমরা অগ্রসর হচ্ছি একটি যুগপৎ প্রশাসনিক দ্বৈতকাঠামো (পোস্টিং, বদলি ও শৃঙ্খলা সংক্রান্ত) অবসানের পথে। এর মাধ্যমে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত হবে।

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এবং ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (UNDP), বাংলাদেশ-এর যৌথ উদ্যোগে আজ বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) সকাল ১১টা ৩০ মিনিটে বরিশালের হোটেল গ্র্যান্ড পার্কে “Judicial Independence and Efficiency in Bangladesh” শীর্ষক  রেজিওনাল সেমিনারে তিনি এ কথা বলেন।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ ও বিচারসেবা প্রদানে দক্ষতা বৃদ্ধির করণীয় নিয়ে আয়োজিত এই সেমিনার ছিল পুরো সেমিনার সিরিজের সর্বশেষ আয়োজন। এর আগে দেশের সাতটি বিভাগীয় শহরে (ঢাকা, চট্টগ্রাম, মৌলভীবাজার–সিলেট, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, রংপুর ও খুলনা) আটটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকায় অনুষ্ঠিত দুটি সেমিনারের মধ্যে একটি ছিল আঞ্চলিক এবং অপরটি জাতীয়। জাতীয় সেমিনারটি হয় গত ২২ জুন ২০২৫ খ্রিস্টাব্দে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে, যেখানে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ও আইন উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন।

আজকের বরিশাল সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি জনাব ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। তিনি সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের মাননীয় বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী। শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন UNDP, Bangladesh-এর রেসিডেন্ট রিপ্রেজেন্টেটিভ স্টিফান লিলার।

সেমিনারে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার, সুইডেনের রাষ্ট্রদূত নিকোলাস উইকস, নরওয়ের রাষ্ট্রদূত মি. হকোন অ্যারাল্ড গুলব্র্যান্ডসেন এবং ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক। তাঁরা সবাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও আধুনিকায়ন প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন।

বক্তব্যের শুরুতে প্রধান বিচারপতি বলেন, এক বছর পূর্বে ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রি. তারিখে বিচার বিভাগ সংস্কারে যে রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছিলো সেই রোডম্যাপ এখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। এর ফলে বদলে গিয়েছে আদালতের সংস্কৃতি, জনগণের প্রত্যাশা, এবং প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা।

প্রধান বিচারপতি তাঁর ভাষণে সংস্কার যাত্রায় কিছু উল্লেখযোগ্য অর্জনের কথা তুলে ধরেন। উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আইনজ্ঞ, গবেষক ও নাগরিকেরা দাবি করে আসছিলেন একটি স্বচ্ছ, বিশ্বাসযোগ্য এবং কলিজিয়ামভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়ার যার মাধ্যমে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হবে।

তিনি বলেন, সুপ্রীম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল অর্ডিন্যান্স-২০২৫ প্রণয়নের মাধ্যমে সেই প্রত্যাশা পূর্ণ হয়েছে। ইতোমধ্যেই এই প্রক্রিয়ায় আপীল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। এর মাধ্যমে বহু প্রতীক্ষিত জাতীয় ঐকমত্য আজ আইনে রূপান্তরিত হয়েছে এবং জনআস্থার যোগ্য একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সুদৃঢ় হচ্ছে।

বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক পৃথকীকরণ প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, একটি পৃথক সুপ্রীম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠার ভিত্তি প্রায় সম্পূর্ণ। অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের সক্রিয় সহযোগিতা ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী আমরা অগ্রসর হচ্ছি একটি যুগপৎ প্রশাসনিক দ্বৈতকাঠামো (পোস্টিং, বদলি ও শৃঙ্খলা সংক্রান্ত) অবসানের পথে। এর মাধ্যমে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত হবে।

সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনরুজ্জীবনের এবং এর কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রায় এক দশক ধরে স্থবির থাকা সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতিদের শৃঙ্খলা ও অপসারণের সাংবিধানিক প্রক্রিয়া পুনঃস্থাপন কার হয়েছে।

বিচার প্রক্রিয়ায় আধুনিকায়ন এবং বিচারপ্রার্থীদের জন্য হেল্প-লাইন সার্ভিস চালুকরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টসহ দেশের ৮টি বিভাগীয় শহর ও ৬৪টি জেলায় হেল্পলাইন সার্ভিস চালু করা হয়েছে। এ সব কিছুর মাধ্যমে বাংলাদেশের বিচার প্রক্রিয়ার আমূল পরিবর্তিত হয়েছে।

প্রধান বিচারপতি বলেন সংস্কার রোডম্যাপের আরেকটি মাইলফলক হলো দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা পৃথকীকরণ। এছাড়া, জেলা পর্যায়ে ২৩২টি নতুন বিচারিক পদ সৃষ্টি করা হয়েছে মর্মে তিনি তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন। এগুলো ক্রমবর্ধমান মামলা জট নিরসন এবং মামলা নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রিতা নিরসন করবে।

বিশেষায়িত বাণিজ্য আদালত প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের উদ্যোগে বাণিজ্যিক আদালত অধ্যাদেশ ২০২৫ এর খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশটি কেবল বিশেষায়িত আদালতই নয়, বরং দক্ষ বিচারক, প্রযুক্তিনির্ভর প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে বাণিজ্য সংক্রান্ত বিরোধগুলোর দ্রুত ও নিশ্চিত সমাধান পাওয়া যায় তা নিশ্চিত করবে।

তিনি বলেন, এর ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি পাবে এবং বাংলাদেশে ease of doing business পরিবেশ আরও শক্তিশালী হবে।

প্রধান বিচারপতি উল্লেখ করেন, তিনি ব্যাংকক থেকে দুবাই, জোহানেসবার্গ থেকে সাও পাওলোতে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা সংস্কার ও স্বাধীনতার পতাকা তুলে ধরেছেন। বিভিন্ন দেশের প্রধান বিচারপতিদের সঙ্গে আলোচনায় করেছেন যাতে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা হয় তুলনামূলক, উন্মুক্ত ও বৈশ্বিক।

উল্লেখ্য, প্রধান বিচারপতি বিগত ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রি. তারিখ তাঁর দেওয়া অভিভাষণে বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপ তুলে ধরেন, যাতে তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্বতন্ত্রীকরণ ও বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক পৃথকীকরণ এর বিষয়ে বিশদ আলোকপাত করেন। এছাড়া, প্রধান বিচারপতি তাঁর রোডম্যাপ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের অর্থপূর্ণ সংস্কার নিশ্চিতকল্পে বিভিন্ন স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার রূপরেখা ও কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরেন।

সেই কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে এবং বিচারবিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতার গুরুত্ব উপলব্ধিপূর্বক সেই বার্তা সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে “Judicial Independence and Efficiency in Bangladesh” -শীর্ষক সেমিনার আয়োজনের মাধ্যমে তিনি সমগ্র বাংলাদেশের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সাথে সভা-সেমিনার ও মতবিনিময় করেছেন।

সেমিনারে স্বাগত বক্তব্যে স্টেফান লিলার দেশের বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বতন্ত্রীকরণে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ঘোষিত বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপ একটি যুগোপযোগী পদক্ষেপ মর্মে মন্তব্য করেন এবং উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশের বিভাগের জন্য ঐতিহাসিক এই মুহূর্তে বিচার বিভাগের আধুনিকায়নে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে পাশে থাকার আশ্বাস পুনঃর্ব্যক্ত করেন।

বরিশালের জেলা ও দায়রা জজ আদালত, মহানগর দায়রা জজ আদালত, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, শ্রম আদালত এবং বিভিন্ন ট্রাইব্যুনালের বিচারকবৃন্দ, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ভোলা জেলার বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সরকারি কৌশুলি, পাবলিক প্রসিকিউটরসহ আমন্ত্রিত অতিথিরাও উপস্থিত ছিলেন।

উল্লেখ্য, সুপ্রীম কোর্টের পরামর্শক্রমে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের প্রশিক্ষণ শাখা থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দে এ সংক্রান্ত সরকারি আদেশ জারি করা হয়েছিল।