রাজীব কুমার দেব

১/১ বি.এস খতিয়ান সংশোধন: ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার কতটুকু?

রাজীব কুমার দেব : বাংলাদেশের ভূমি আইনে বর্তমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রায়শ দেখা যায় এমন প্রশ্ন হচ্ছে – ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল (এল. এস. টি) কি ১/১ বি.এস খতিয়ান, যেখানে মালিক হিসেবে সরকারের নাম প্রকাশিত হয়েছে, সেটি সংশোধন করতে পারে? কিংবা কোন ব্যক্তি কি এই খতিয়ান সংশোধনের জন্য ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে পারেন?

উত্থাপিত আলোচনার অবতারণাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বাস্তবিক আইনগত ইস্যু উত্থাপন করেছে, যা বিশেষভাবে “অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আইন, ২০০১ (সংশোধিত ২০১১ ও ২০১২)” এবং এল. এস. টি কর্তৃক ১/১ খতিয়ানের সংশোধন প্রক্রিয়ার প্রেক্ষাপটে বিচারিক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে।

যেহেতু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণের আবেদন করা হয়নি, এবং সেই সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার ফলে সংশ্লিষ্ট খতিয়ানে (১/১) সরকারের নামে নাম প্রকাশিত হয়েছে, তাই এখন সেই আবেদনকারী এল. এস. টি-তে খতিয়ান সংশোধনের আবেদন করতে পারবেন কিনা?

কে, কখন ও কী পরিস্থিতিতে এল. এস. টি-এ আবেদন করতে পারেন?

রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ এর ধারা ১৪৫এ অনুযায়ী, চূড়ান্ত রেকর্ড-অফ-রাইটস (আর. ও. আর) প্রকাশিত হওয়ার পর যদি কোনো ব্যক্তি মনে করেন যে উক্ত রেকর্ডে তার স্বত্ব, দখল বা মালিকানা সংক্রান্ত ভুল, অসঙ্গতি বা অনিয়ম রয়েছে, তবে তিনি সরাসরি এল. এস. টি-এ সংশোধনের আবেদন করতে পারেন।

অর্থাৎ, রেকর্ড প্রকাশের পর যদি কারো নামে জমি না থেকে থাকে, অথচ পূর্ববর্তী জরিপে (যেমন সিএস/এসএ/আরএস) তার নাম ছিল; অথবা যদি জমি ভুলভাবে সরকারের নামে রেকর্ড করা হয়; তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এল. এস. টি-তে আবেদন করার অধিকার রাখেন।

তবে এটি শর্তসাপেক্ষে। এল. এস. টি শুধুমাত্র চূড়ান্ত প্রকাশিত খতিয়ানের সংশোধন নিয়ে কাজ করতে পারে। মালিকানা বা দখল সংক্রান্ত জটিল বিষয় সাধারণ দেওয়ানি আদালতের বিষয়বস্তু।

১/১ খতিয়ানের প্রকৃতি ও আইনি অবস্থান

প্রচলিত আইন, বিধি ও নির্দেশিকা অনুসরণ করে বাংলাদেশে “১/১ খতিয়ান” চূড়ান্তভাবে প্রচার ও প্রকাশিত হয়েছে। যেমন –

  • সার্ভে আইন, ১৯৩৫

  • রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ (সংশোধনী ২০০৪)

  • পূর্ববাংলা রেকর্ড ম্যানুয়াল

  • ক্যাডেস্ট্রাল/রিভিশনাল/বাংলাদেশ সার্ভে নির্দেশিকা

“১/১ খতিয়ান” সাধারণত সরকারি মালিকানাধীন ভূমির রেকর্ড বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এটি খারিজী খতিয়ান নয়, প্রশাসনিক স্তরের বিন্যাসের কারণে এর সংখ্যা তিকরণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশে “১/১ খতিয়ান” হিসেবে পরিচিত রেকর্ড-অফ-রাইট একটি ভূমি রেকর্ডে সরাসরি সরকারি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত স্বয়ংসম্পূর্ণ দলিল নয়। তবে প্রচলিত আইন অনুসারে (বর্ণিত আইন ও সাক্ষ্য আইন) এই ১/১ বি.এস খতিয়ান চূড়ান্তভাবে রাজস্ব রেকর্ডে প্রকাশিত রেকর্ড-অফ-রাইটস (সিএস/এসএ/বিএস খতিয়ান) কে আইন অনুযায়ী সঠিক ধরা হয়, যতক্ষণ না বিপরীত প্রমাণিত হয়।

এই ১/১ বি.এস খতিয়ান এর মর্যাদা চূড়ান্ত প্রকাশিত রেকর্ড-অফ-রাইটস (যেমন সিএস বা আরএস/এসএ এন্ট্রি) আইনীভাবে “সঠিকতার অনুমান” ধরে নেওয়া হয়, অর্থাৎ যেমনটি প্রকাশিত সেখানেই সঠিক, যতক্ষণ না আদালতে এর বিপরীতে প্রমাণ হয়।

এল. এস. টি কি ১/১ বি.এস খতিয়ান সংশোধন করতে পারে?

এল. এস. টি বি.এস রেকর্ডকে ‘ভুল’ ঘোষণা করতে পারে এবং সংশ্লিষ্ট অফিসকে সংশোধনের জন্য নির্দেশ দিতে পারে। তবে এর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন –

  • এল. এস. টি শুধুমাত্র সর্বশেষ প্রকাশিত স্বত্বলিপি সংশোধনের ক্ষমতা রাখে।

  • খতিয়ানের মালিকানা ও দখল সংক্রান্ত বিতর্ক যেমন ঔপনিবেশিক দখল, সশরীরে দখল ইত্যাদি এল. এস. টি-র আওতায় পড়ে না, বরং সাধারণ দেওয়ানি আদালতে যাওয়া উচিত।

অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আইন, ২০০১ (সংশোধিত ২০১১ ও ২০১২) এবং রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ – এ দুটি পৃথক আইন এবং পৃথক ট্রাইব্যুনালের আওতাধীন, একটির উপর আরেকটির নিয়ন্ত্রণ নেই।

উভয় আইন নির্দিষ্ট সময়ে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন অধিকার সৃষ্টি করে এবং একটির অধিকার অন্যটির অধিকারকে খর্ব করতে পারে না।  যেমন: অর্পিত সম্পত্তি আইনে: নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আবেদন না করায় সরকারের নামে নাম চূড়ান্ত হয়েছে এবং এল, এস, টি আইনে: খতিয়ান সংশোধন আবেদন করার প্রশ্ন উঠে।

এই দুই কজ অব একশন (মামলার কারণ) একে অপরকে বাতিল বা সীমিত করতে পারেনা। অর্থাৎ সম্পত্তি আইনে সৃজিত কজ অব একশন নির্ধারিত সময়ে অনুসরন না করার ফলে এল, এস, টি আইনের মাধ্যমে সৃজিত কজ অব একশনকে অস্বীকার করা যাবেনা। ফলে, অর্পিত সম্পত্তি আইনে আবেদন না করায় এল, এস, টি আইনে সংশোধনের সুযোগ অস্বীকার করা যাবেনা। এটি আইনের মৌলিক নীতির পরিপন্থী হবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই ১/১ বি এস খতিয়ানের বিরুদ্ধে এল, এস, টি এ মামলা করা যায় কি? হ্যা, তবে শর্তসাপেক্ষে যদি এই খতিয়ানে ভুলভাবে জমিকে “সরকারি খাস জমি” হিসেবে দেখানো হয়েছে, যদি আবেদনকারী প্রকৃত মালিক ছিলেন বা আছেন এবং তার নামে পূর্ববর্তী সিএস/ এস এ/ আর এস খতিয়ানে জমিছিল।

তবে এল, এস, টি অর্পিত সম্পত্তির তালিকা হতে অবমুক্তির বিষয়ে কিংবা মালিকানা বা টাইটেল ইস্যু নির্ধারণ করতে পারে না। টাইটেল/মালিকানার (বিশেষভাবে”ক” তফসিলোক্ত সম্পত্তির অবমুক্তির প্রশ্ন আসলে) বিতর্ক থাকলে আবেদনকারীকে সিভিল কোর্টে মামলা করতে হবে।

“খ শ্রেণীর” অর্পিত সম্পত্তির ক্ষেত্রে এল. এস. টি-র এখতিয়ার

অর্পিত সম্পত্তির প্রত্যার্পণ আইন, ২০০১ (সংশোধিত ২০১১ ও ২০১২) অনুযায়ী, “গেজেট ভিত্তিক অবমুক্তি” সাধারণত “খ শ্রেণীর” অর্পিত সম্পত্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

যদি আবেদনকারী “খ শ্রেণীভুক্ত” জমির ১/১ বি.এস খতিয়ান সংশোধনের জন্য এল. এস. টি-তে আবেদন করেন, তবে তা যথাযথ এবং এল. এস. টি তা নিষ্পত্তি করতে পারবেন।

এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ বা ভূমি মন্ত্রণালয়ের সার্কুলার দেখিয়ে বলা যাবে না যে, সহকারী কমিশনার (ভূমি) বা এসিল্যান্ড যেখানে নামজারী করতে বাধ্য, সেখানে এল, এস, টি এখতিয়ার নেই- এ যুক্তি প্রযোজ্য নয়।

বাস্তবতা হলো, এই প্রক্রিয়ায় নামজারিতে(এসিল্যান্ড অফিসে) অপ্রত্যাশিত জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা; এমনকি প্রশাসনিক বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়ে থাকে বিধায় আবেদনকারী এল, এস, টি বা আদালতের দ্বারস্থ হয়ে থাকেন।

“ক শ্রেণীর” অর্পিত সম্পত্তির ক্ষেত্রে এল. এস. টি-র এখতিয়ার

“ক শ্রেণীভুক্ত” অর্পিত সম্পত্তি এমন জমি যা সরকার স্থায়ীভাবে অধিগ্রহণ করেছে, অর্থাৎ তা সরকারের মালিকানায় পরিণত হয়েছে।

এল. এস. টি-তে যদি আবেদনটি “ক শ্রেণীভুক্ত” জমি সংক্রান্ত হয়, তাহলে এল. এস. টি তার এখতিয়ার প্রয়োগ করতে পারবেন না। ১/১ বি.এস খতিয়ান সংশোধনের জন্য দেওয়ানি আদালতেই মামলা করতে হবে। এল. এস. টি-তে এ বিষয়ে প্রতিকার নেই।

লেখক : রাজীব কুমার দেব; সিনিয়র সহকারী জজ, নবীনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।