সারা দেশের অধস্তন আদালতগুলোতে প্রায় এক বছর ধরে সহায়ক কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। বিগত সরকারের আমলে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠার পর নতুন নিয়োগবিধি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ায় এই অচলাবস্থা তৈরি হয়। বর্তমানে আদালতগুলোতে তিন হাজারের বেশি পদ শূন্য। তবে নিয়োগবিধি সংশোধনের কাজ শেষ হয়েছে, এবং নতুন সংশোধনীতে এসব নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনকে (বিজেএসসি)।
গতকাল সোমবার (৬ অক্টোবর) আইন মন্ত্রণালয় থেকে সংশোধিত নিয়োগবিধি প্রজ্ঞাপন জারির জন্য বিজি প্রেসে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, সোমবার রাতেই বা আজ মঙ্গলবার প্রজ্ঞাপনটি জারি হতে পারে।
নিয়োগ বাণিজ্যের পটভূমি
বিগত সরকারের আমলে অধস্তন আদালতের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের অনিয়ম ঘটে। অভিযোগ ওঠে—সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নির্দেশে গঠিত সিন্ডিকেট জনপ্রতি ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে অযোগ্য ও অদক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়েছে।
জানা গেছে, সারা দেশে নিয়োগ পাওয়া তিন হাজারের বেশি কর্মচারীর বড় অংশই এসেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলা থেকে, যা সাবেক মন্ত্রীর নিজ এলাকা।
ফলে আদালতগুলোর দৈনন্দিন কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেয়, কারণ বহু নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি আদালতের ন্যূনতম কাজও জানতেন না।
রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর আইন মন্ত্রণালয় এসব অনিয়ম নিয়ে তদন্তে নামে। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বিষয়টি দেখে হতবাক হন এবং পরবর্তীতে নিয়োগবিধি সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেন।
সংশোধনের পর সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষমতা জেলা জজদের কাছ থেকে তুলে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের হাতে।
কোন কোন বিধিমালা সংশোধন হলো
দুটি নিয়োগবিধি সংশোধন করা হয়েছে—
১. জেলা জজ ও অধস্তন আদালতগুলো (কর্মকর্তা ও কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮৯
২. জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসি ও মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসির আদালতগুলো (সহায়ক কর্মকর্তা ও কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা, ২০০৮
এখন থেকে বাছাই ও নিয়োগের দায়িত্বে থাকবে জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন।
আগের বিধিতে যা ছিল
আগে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় একজন অতিরিক্ত জেলা জজ, একজন যুগ্ম জেলা জজ এবং একজন সিনিয়র সহকারী জজ মিলে একটি কমিটি গঠন করা হতো। তারা প্রার্থী বাছাই করে জেলা জজের কাছে সুপারিশ পাঠাতেন, এবং জেলা জজ চূড়ান্ত নিয়োগ দিতেন। কিন্তু বাস্তবে আইন মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে ব্যাপক দুর্নীতি ও ঘুষের লেনদেন চলত।
নতুন বিধিতে যা থাকছে
নতুন বিধিতে বলা হয়েছে—
-
নির্দিষ্ট পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে জেলা জজ নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করবেন, তবে প্রার্থী বাছাই করবেন জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন।
-
কমিশন লিখিত, ব্যবহারিক (যদি প্রযোজ্য হয়) ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থী বাছাই করবে।
-
কমিশন বাছাইকৃত প্রার্থীদের তালিকা জেলা জজের কাছে পাঠাবে, এবং জেলা জজকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে নিয়োগ সম্পন্ন করতে হবে।
-
কোনো পদ শূন্য হওয়ার এক মাসের মধ্যে জেলা জজকে শূন্যপদের তথ্য কমিশনের কাছে পাঠাতে হবে।
-
কমিশন বছরে এক বা একাধিকবার কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে।
-
প্রয়োজনে মৌখিক পরীক্ষার জন্য জুডিসিয়াল সার্ভিসের কর্মকর্তাদের নিয়ে বোর্ড গঠন করা যাবে এবং বিশেষজ্ঞ সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা যাবে।
একটি বিশেষ বিধান হিসেবে বলা হয়েছে—বিধিমালার এ সংশোধনী কার্যকর হওয়ার তারিখে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অধীনে চলমান কোনো সরাসরি নিয়োগের কার্যক্রমে লিখিত পরীক্ষা গ্রহণ সম্পন্ন না হলে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ বৈধ প্রার্থীদের আবেদনগুলো, তদ্সংযুক্ত কাগজাদি (যদি থাকে) ও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বিধিমালার এ সংশোধনী কার্যকর হওয়ার সাত কার্যদিবসের মধ্যে বাছাইকারী কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করবে।
বাছাইকারী কর্তৃপক্ষ বর্ণিত আবেদন, তদ্সংযুক্ত কাগজাদি (যদি থাকে) ও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রাপ্তির পর তার ভিত্তিতে বাছাই সংক্রান্ত কার্যক্রম গ্রহণ করবে এবং এ ক্ষেত্রে নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও আবেদন আহ্বানের প্রয়োজন হবে না। তবে বিধিমালার এ সংশোধনী কার্যকর হওয়ার তারিখে কোনো নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অধীনে সরাসরি নিয়োগের কার্যক্রমে লিখিত পরীক্ষা সম্পন্ন হয়ে থাকলে এবং তৎপরবর্তী কোনো ধাপ অনিষ্পন্ন থাকলে ওই পদের নিয়োগ ও বাছাই কার্যক্রম এমনভাবে সম্পন্ন করতে হবে যেন বিধিমালার এ সংশোধনী জারি হয়নি।
সংশ্লিষ্টদের প্রতিক্রিয়া
বিচারক ও আইনজীবী মহলে এই পদক্ষেপকে “যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত” হিসেবে দেখা হচ্ছে। একাধিক বিচারক বলেন, “বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষায় এই পদক্ষেপ ছিল সময়ের দাবি। ঘুষের বিনিময়ে নিয়োগ পাওয়া অযোগ্য কর্মচারীদের কারণে বিচার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল।”
বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম বলেন,
আমরা অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। আশা করি, কমিশনের মাধ্যমে আদালতে দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ হবে। দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ হলে বিচারপ্রার্থীদের প্রত্যাশিত সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।
সংশোধিত বিধিমালা অনুযায়ী এখন থেকে আদালত প্রশাসনে নিয়োগ প্রক্রিয়া হবে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ, প্রতিযোগিতামূলক এবং কেন্দ্রীভূত। আশা করা হচ্ছে, এ ব্যবস্থার ফলে অদক্ষ নিয়োগ বন্ধ হবে এবং বিচার বিভাগের কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে।