আল মুস্তাসিম নবী নিকু
আল মুস্তাসিম নবী নিকু

আর্থিক পাওনা আদায়ে মানি সুটের সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনা: তামাদি আইনের প্রভাব ও প্রতিকার

বাংলাদেশের দেওয়ানি আদালতে ঋণ বা আর্থিক প্রতারণা সম্পর্কিত মামলা একটি বহুল প্রচলিত বিষয়। ব্যবসায়িক লেনদেন, ঋণ-দেনা, ব্যাংকিং লেনদেন, অংশীদারি ব্যবসা, সাপ্লাই চুক্তি, বন্ধুবান্ধবের কাছে ধার, ঠিকাদারি চুক্তি কিংবা প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎ— এসব থেকেই দেখা দেয় আর্থিক বিরোধ, যার চূড়ান্ত পরিণতি হয় আদালতে দায়ের করা “মানি সুট”।

তবে বাস্তবতা হলো, অনেক ক্ষেত্রে মামলা দায়েরের সময় পেরিয়ে যায়, বাদী দেরিতে পদক্ষেপ নেন এবং ততদিনে মামলা “তামাদি” (BARRED BY LIMITATION) হয়ে পড়ে। ফলে, বহু সত্যিকারের দাবিও আইনি রাস্তায় ব্যর্থ হয়। এ লেখায় তামাদি আইন ও তার প্রভাব বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে কীভাবে বাদী তার দাবির পেছনে আইনি কৌশল অবলম্বন করতে পারেন, এবং কোন পরিস্থিতিতে আদালতের দৃষ্টিতে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব হতে পারে।

তামাদি আইন: একটি মৌলিক কাঠামো

বাংলাদেশের তামাদি আইন হলো তামাদি আইন, ১৯০৮, যার মূল উদ্দেশ্য হলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির জন্য আদালতের সামনে একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া। এই আইনের ধারা ৩ অনুযায়ী, যদি কোনো মামলা তামাদির মধ্যেই পড়ে, তাহলে আদালত এমনকি প্রতিপক্ষ তামাদির কথা না তুললেও SUO MOTU (স্বয়ংক্রিয়ভাবে) মামলা খারিজ করে দিতে পারে। এই আইনের পেছনে নীতিগত উদ্দেশ্য হলো আদালতকে অপ্রয়োজনীয় দীর্ঘসূত্রতা থেকে রক্ষা করা এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পক্ষদ্বয়কে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করা।

মানি সুটে তামাদির সময়সীমা

তামাদি আইন, ১৯০৮ এর তফসিল ১ অনুযায়ী, চুক্তিভিত্তিক বা ঋণ-সংক্রান্ত আর্থিক দাবি বা মানি সুট বা পাওনা টাকা আদায়ের ক্ষেত্রে সময়সীমা নির্ধারিত হয় অনুচ্ছেদ ৫৭ অনুযায়ী ৩ বছর, যা শুরু হয় চুক্তি লঙ্ঘনের দিন থেকে, বা অর্থ ফেরতের বিষয় অস্বীকার করার মাধ্যমে Cause Of Action সৃষ্টির দিন থেকে। এখানে Cause Of Action বলতে বোঝায় যখন দাবি বাস্তবায়নের জন্য যথাযথভাবে আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি কারো কাছ থেকে ধার নেওয়া অর্থ নির্ধারিত সময়ে ফেরত না দেওয়া হয়, তবে ফেরতের সময় পার হওয়ার দিন থেকেই তামাদি সময় গণনা শুরু হবে।

ধারা ১৮, ১৯ ও ২০; তামাদি নবায়নের বিধান:

তামাদি আইন যথেষ্ট কঠোর হলেও ধারা ১৮, ১৯ ও ২০ কিছুটা নমনীয়তা এনে দেয়।

প্রতারণার প্রভাব – ধারা ১৮
এই ধারায় বলা হয়, যদি প্রতিপক্ষ প্রতারণা বা জালিয়াতির মাধ্যমে দাবির বিষয় গোপন রাখে, এবং বাদী তা অনেক পরে জানেন, তাহলে তামাদি সময়সীমা শুরু হবে প্রতারণা আবিষ্কারের দিন থেকে। তবে শর্ত হচ্ছে প্রতারণার অভিযোগকে নির্ভরযোগ্যভাবে প্রমাণ করতে হবে।

লিখিত স্বীকৃতি – ধারা ১৯
এই ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি তার দায় স্বীকার করে এবং তা লিখিত আকারে করে, তবে স্বীকৃতির তারিখ থেকে নতুন করে তিন বছরের সময়সীমা গণনা শুরু হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ১ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে ঋণ নেওয়া হয়, কিন্তু কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তখন ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে মামলা করতে হতো। কিন্তু যদি ১ জুলাই ২০২৫ তারিখে এক চিঠিতে তিনি লেখেন, “আমি তোমার ৫০,০০০ টাকা এখনও ফেরত দিতে পারিনি”, তাহলে স্বীকৃতির ১ জুলাই ২০২৫ ওই তারিখ থেকে নতুন তিন বছর শুরু হবে।

আংশিক অর্থ প্রদান বা সুদের অর্থ প্রদান – ধারা ২০
এই ধারানুযায়ী, যদি দায়ী ব্যক্তি আংশিক টাকা ফেরত দেন বা সুদের টাকা প্রদান করেন এবং সেটি লিখিতভাবে স্বাক্ষরযুক্ত থাকে, তবে নতুন করে সময় গণনা শুরু হবে। তবে শর্ত, ওই পরিশোধ তামাদি সময়সীমার মধ্যেই হতে হবে। স্বাক্ষরসহ লিখিত প্রমাণ থাকতে হবে। এই ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, মৌখিক স্বীকারোক্তি, সাক্ষী বা ফোনালাপ গ্রহণযোগ্য নয়।

তামাদি হলেও মামলা করার সম্ভাবনা: আইনগত কৌশল

দেওয়ানি কার্যবিধি ১৯০৮ এর আদেশ VII বিধি ৬
বাদী তার আরজিতে যদি উল্লেখ করেন যে মামলা তামাদি বলে মনে হলেও “তামাদি থেকে অব্যাহতি” এর সুযোগ রয়েছে, তাহলে আদালত বিবেচনা করতে পারেন মামলা গ্রহণযোগ্য কিনা।

নতুন স্বীকৃতি বা আংশিক পরিশোধ আদায়ের চেষ্টা
আইনজীবীর মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়ে লিখিত স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করা যেতে পারে। লিখিত কোনো উত্তর বা অংশ পরিশোধ একটি নতুন cause of action তৈরি করতে পারে। তামাদি আইন অনুযায়ী মামলা করার একটি নির্ধারিত সময়সীমা থাকে। তবে কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে আইনের ১৮, ১৯ ও ২০ ধারানুযায়ী সময়সীমা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।

যদি প্রতিপক্ষ প্রতারণা করে দাবি গোপন রাখে এবং পরে তা ধরা পড়ে, তখন সময় নতুনভাবে শুরু হয়। কোনো ব্যক্তি দায় স্বীকার করে যদি লিখিতভাবে জানায়, তাহলে স্বীকারের তারিখ থেকে সময় গণনা শুরু হয়। একইভাবে, যদি কেউ আংশিক টাকা বা সুদের টাকা দেয় এবং তা লিখিত ও স্বাক্ষরিত হয়, তাহলে সময় আবার শুরু হয়।

নৈতিক ও আইনি ঝুঁকি: মিথ্যা স্বীকৃতি দেখানো

অনেক সময় দেখা যায়, বাদী আইনি সীমাবদ্ধতা কাটাতে আরজিতে ভুল তথ্য দেন, যেমন প্রতিপক্ষ আংশিক টাকা দিয়েছেন বলে উল্লেখ করা, অথচ বাস্তবে তা হয়নি বা মিথ্যা স্বীকৃতি তৈরি করা। এই ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, এ ধরনের কাজ দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর ধারা ১৯৩, ১৯৯ ও ২০০ অনুযায়ী “PERJURY” বা মিথ্যা স্বাক্ষ্য প্রদানের অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। যার ফলে ফৌজদারি মামলা, আদালতের ক্ষোভ ও অবিশ্বাস, কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড ধার্য, মামলা খারিজ এবং আইনি বিপদ হতে পারে। তাই আইনজীবীর পক্ষে ক্লায়েন্টকে পরামর্শ দেওয়া একান্ত জরুরি যে, মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির কারণ হতে পারে।

বিকল্প প্রতিকার ও কৌশল

১. ADR বা Alternative Dispute Resolution – সালিশি বা মধ্যস্থতা প্রক্রিয়ায় সমঝোতার মাধ্যমে টাকা আদায়ের চেষ্টা করা যেতে পারে, যেখানে আইনের কঠোর সময়সীমা বাধা হয় না।
২. নতুন চুক্তি বা স্বীকারোক্তি আদায় – লিখিত একটি নতুন Acknowledgment আদায়ের চেষ্টা করতে পারেন। এতে নতুন তামাদি সময় শুরু হয়।
৩. ফৌজদারি অভিযোগ পুনঃউত্থাপন – যদি প্রতারণার বিষয়টি গুরুতর হয়, তবে দণ্ডবিধি-এর ধারা ৪২০ (প্রতারণা) বা ধারা ৪০৬ (অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ) এর আওতায় নতুন ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে গুরুত্বের সাথে মনে রাখতে হবে, দেওয়ানি পাওনার জন্য ফৌজদারি মামলার অপব্যবহার আদালত পছন্দ করে না।

পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের তামাদি আইন একদিকে যেমন ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করতে পারে, তেমনি দীর্ঘসূত্রতা ও অব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিরোধও বটে। তবুও আইন তার কাঠামোর মধ্যেই কার্যকর। বাদী যদি সচেতন থাকেন, আইনজীবীর সঠিক পরামর্শ গ্রহণ করেন, এবং যথাসময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেন, তবে আইনের ভেতর থেকেই প্রতিকার পাওয়া সম্ভব। মনে রাখতে হবে, মিথ্যা তথ্য, জাল স্বীকারোক্তি ও পরোক্ষ চাপ প্রয়োগ আইন ও নৈতিকতা উভয়ের পরিপন্থী। সুতরাং সততা, সময়জ্ঞান, ও কৌশলী আইনি ব্যবস্থা গ্রহণই মানি সুটে সফলতার চাবিকাঠি।

লেখক : আল মুস্তাসিম নবী নিকু, অ্যাডভোকেট, ঢাকা ও পাবনা জজ কোর্ট