নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের ‘ঐতিহাসিক’ পদক্ষেপ
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট

বিক্রয় চুক্তি বাস্তবায়নে ব্যর্থতা প্রতারণা নয়, যদি শুরুতেই প্রতারণার অভিপ্রায় প্রমাণিত না হয়: ভারতের সুপ্রিম কোর্ট

নয়াদিল্লি: ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে যে, শুধুমাত্র বিক্রয় চুক্তি বাস্তবায়নে ব্যর্থতা বা অর্থ ফেরত না দেওয়ার অভিযোগ যথেষ্ট নয় ধারা ৪২০ আইপিসি (IPC) অনুযায়ী প্রতারণার অভিযোগ প্রমাণের জন্য, যদি না লেনদেনের শুরু থেকেই প্রতারণামূলক বা অসৎ উদ্দেশ্য প্রমাণিত হয়।

বিচারপতি বি. ভি. নাগরথ্না এবং বিচারপতি আর. মহাদেবন সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই রায় দেন ঝাড়খণ্ড হাইকোর্টের এক আদেশের বিরুদ্ধে দায়ের করা আপিলের শুনানিতে। হাইকোর্টের ওই আদেশে ধারা ৪৮২ সিআরপিসি অনুযায়ী দায়ের করা এক আবেদন খারিজ করা হয়েছিল, যেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তি ফৌজদারি কার্যক্রম বাতিলের আবেদন করেছিলেন।

বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ

রায়ে বেঞ্চ বলেন, “শুধু এই অভিযোগ যে অভিযুক্ত বিক্রয় চুক্তি বাস্তবায়ন করেননি এবং অর্থ ফেরত দেননি, তা কোনোভাবেই ধারা ৪২০ আইপিসি অনুযায়ী ‘dishonest inducement’ বা প্রতারণামূলক প্ররোচনা প্রমাণ করে না।”

বিচারপতিরা স্পষ্ট করেন, চুক্তি করার সময় থেকেই যদি কোনো ব্যক্তি প্রতারণার উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করেন, কেবল তখনই সেটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। “এই ধরনের অপরাধমূলক অভিপ্রায় অনুমান করা যায় না, বরং তা অবশ্যই যথাযথ তথ্য-প্রমাণের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হয়,” বেঞ্চ মন্তব্য করে।

এই মামলায় আবেদনকারীর পক্ষে উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী স্রিজা চৌধুরী, আর প্রতিপক্ষের পক্ষে ছিলেন রাজীব শঙ্কর দ্বিবেদী

ঘটনার পটভূমি

মামলার বাদী একজন সম্পত্তির মালিক ছিলেন, যিনি ২০১৩ সালে অভিযোগকারী ব্যক্তির সঙ্গে ৪৩ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বিক্রয় চুক্তি করেন। এর মধ্যে অভিযোগকারী ২০ লক্ষ টাকা অগ্রিম প্রদান করেন।

তবে পরবর্তীতে বিক্রয় দলিল সম্পাদিত হয়নি। আট বছর পর, ২০২১ সালে অভিযোগকারী ব্যক্তি অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ ও এফআইআর দায়ের করেন। অভিযোগে ধারা ৪০৬ (অপরাধজনক আস্থাভঙ্গ), ৪২০ (প্রতারণা) এবং ১২০বি (ষড়যন্ত্র) উল্লেখ করা হয়।

এরপর উভয় পক্ষ মধ্যস্থতার মাধ্যমে সমঝোতার চেষ্টা করে। অভিযুক্ত কিছু অর্থ ফেরত দিতে সম্মত হলেও নির্ধারিত সময়সীমা মেনে না চলায় তাঁর জামিন বাতিল হয়। পরবর্তীতে তিনি হাইকোর্টে মামলাটি বাতিলের আবেদন করেন, কিন্তু হাইকোর্ট তা নাকচ করে। পরে বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হয়।

সুপ্রিম কোর্টের বিশ্লেষণ

বিচারপতিরা বলেন, প্রতারণার অপরাধ প্রমাণের জন্য “লেনদেনের শুরুতেই” অভিযুক্তের প্রতারণামূলক বা অসৎ উদ্দেশ্য থাকা অপরিহার্য। আদালত Inder Mohan Goswami বনাম State of Uttaranchal মামলার রায় উদ্ধৃত করে বলেন, “কোনো ব্যক্তিকে প্রতারণার দায়ে দোষী প্রমাণ করতে হলে এটা দেখাতে হবে যে তিনি প্রতিশ্রুতির সময় থেকেই প্রতারণামূলক বা অসৎ উদ্দেশ্য পোষণ করছিলেন।”

কিন্তু বর্তমান মামলায় আদালত লক্ষ্য করে যে, এ ধরনের কোনো অভিপ্রায়ের প্রমাণ নেই। রায়ে বলা হয়, “এফআইআর বা অভিযোগপত্রে কোথাও অভিযুক্তের ইচ্ছাকৃত প্রতারণা বা অসৎ উদ্দেশ্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।”

ধারা ৪০৬ অনুযায়ী অপরাধও প্রমাণিত নয়

বেঞ্চ আরও উল্লেখ করে যে, অপরাধজনক আস্থাভঙ্গের জন্য (Section 406 IPC) ‘সম্পত্তি হস্তান্তর’ ও ‘অসৎভাবে আত্মসাৎ’ প্রমাণ করতে হয়। কিন্তু অভিযোগকারীর পক্ষে এ দুই উপাদানের কোনো প্রমাণই আদালতে উপস্থাপন করা হয়নি।

বিচারপতিরা ব্যাখ্যা করেন, “প্রতারণা ও আস্থাভঙ্গ একে অপরের বিপরীত প্রকৃতির অপরাধ। প্রতারণায় অপরাধমূলক উদ্দেশ্য থাকে শুরু থেকেই, আর আস্থাভঙ্গে অপরাধ ঘটে সম্পত্তি হাতে পাওয়ার পর তা অসৎভাবে ব্যবহার করার মাধ্যমে।”

তাঁরা বলেন, “একই ঘটনার প্রেক্ষিতে দুটি অপরাধ একসাথে থাকতে পারে না, কারণ তারা একে অপরের পরিপন্থী।”

দেরিতে মামলা দায়ের ও অভিযোগকারীর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন

সুপ্রিম কোর্ট রায়ে উল্লেখ করে যে, চুক্তির আট বছর পর মামলা দায়ের করা অভিযোগকারীর সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আদালত বলেন, অভিযোগকারী পক্ষের দেওয়ানি প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ থাকলেও তিনি ফৌজদারি মামলা দায়েরের পথ বেছে নিয়েছেন, যা “ব্যক্তিগত প্রতিশোধ বা বিদ্বেষমূলক উদ্দেশ্য” নির্দেশ করতে পারে।

বেঞ্চ সতর্ক করে দেয়, “ফৌজদারি আইনকে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা বা বিরোধ নিষ্পত্তির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়।”

ভুল উদ্দেশ্যে মামলা রোধে আদালতের সতর্কবার্তা

আদালত State of Haryana v. Bhajan Lal মামলার রায় উল্লেখ করে বলে, বর্তমান মামলা সেই ধরনের যেখানে অভিযোগগুলো স্পষ্টভাবে ‘মালাফাইড’ বা অবিশ্বাস্য।

তাছাড়া, Vishal Noble Singh v. State of Uttar Pradesh (2024) মামলার রায়ও উদ্ধৃত করে আদালত সতর্ক করে দেয় যে, ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাকে অপব্যবহার থেকে রক্ষা করতে আদালতকে সতর্ক থাকতে হবে।

রায়ের ফলাফল

সবশেষে সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের আদেশ বাতিল করে অভিযুক্তের পক্ষে রায় দেয়। আদালত বলেন, ধারা ৪০৬, ৪২০ এবং ১২০বি অনুযায়ী কোনো প্রাথমিক অপরাধের উপাদানই এখানে প্রমাণিত হয়নি।

ফলে আদালত অভিযোগ, এফআইআর এবং পুরো ফৌজদারি কার্যক্রম বাতিল করে দেয়।

কেসের নাম: Arshad Neyaz Khan Vs The State of Jharkhand And Another
Neutral Citation: 2025 INSC 1151

পক্ষসমূহের আইনজীবী: