১. প্রেক্ষাপট
বর্তমানে বাংলাদেশে মেডিকেল রিপোর্ট, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট, DNA রিপোর্ট ও ফরেনসিক সার্টিফিকেটসাধারণত সরকারী মেডিকেল কলেজ বা জেলা সিভিল সার্জন অফিসের মাধ্যমে প্রদান করা হয়।
কিন্তু তারা স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা হওয়ায় প্রায়শই প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক চাপের বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্রভাবে রিপোর্ট দিতে পারে না যেমন টা আমরা জুলাই অভ্যুত্থানে শহিদ আবু সাঈদ হত্যা মামলা সহ বিভিন্ন মামলায় দেখেছি। অন্যদিকে, রিপোর্ট প্রদানকারী ডাক্তাররা মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হলেও, ক্লিনিকাল ও প্রশাসনিক দায়িত্বের কারণে আদালতে যথা সময়ে হাজির হতে পারেন না। এর ফলে বহু মামলা দিনের পর দিন ঝুলে থাকে এবং ন্যায্য বিচার ব্যাহত হয়।
সমাধান হিসেবে আমার প্রস্তাব হচ্ছে একটি স্বতন্ত্র জুডিশিয়াল মেডিক্যাল সার্ভিস গঠন। এটি বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের অধীনে থাকবে। এই সার্ভিসের ডিজি হবেন একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি যিনি জুডিশিয়াল এপোয়েন্টমেন্ট কমিটি দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। নিয়োগ প্রাপ্ত ডাক্তাররা হবেন ফরেনসিক মেডিসিনে উচ্চতর ডিগ্রি সম্পন্ন এবং অন্তত ৫ বছর সার্জন হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। তাদের নিয়োগ জাতীয় বেতন স্কেলের ৬ষ্ঠ গ্রেডে হবে যাতে আমরা মেধাবীদের এই সার্ভিসে আকৃষ্ট করতে পারি।
এর মাধ্যমে আদালত ও তদন্ত সংস্থা নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ এবং দ্রুত রিপোর্ট পাবে। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে, প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক প্রভাবের ঝুঁকি কমবে এবং আইনগত প্রক্রিয়া অধিক কার্যকর হবে।
এ ধরনের উদ্যোগবাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার জন্য যুগান্তকারী পরিবর্তনহিসেবে কাজ করবে। শুধু দ্রুত বিচার নয়, এটি নাগরিকদের ন্যায্যতা ও বিচারপ্রতিষ্ঠার প্রতি আস্থা বৃদ্ধি করবে। আজই সময় এসেছে, বিচার ব্যবস্থাকে প্রশাসনিক বাঁধা থেকে মুক্ত করে পেশাদার, স্বতন্ত্র এবং নিরপেক্ষ জুডিশিয়াল মেডিকেল সার্ভিস গঠনের পদক্ষেপ নেওয়ার।
২. প্রস্তাবিত সমাধান
একটি স্বতন্ত্র জুডিশিয়াল মেডিক্যাল সার্ভিস (Judicial Medical Service) গঠন করা হোক, যা বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের অধীনে পরিচালিত হবে।
২.১. কাঠামো
- ডিজি (Director General):একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।
- সিনিয়র জুডিশিয়াল মেডিকেল অফিসার (SJMO):ফরেনসিক মেডিসিনে উচ্চতর ডিগ্রি সম্পন্ন ডাক্তার।
- জুডিশিয়াল মেডিকেল অফিসার (JMO):সার্জন হিসেবে অন্তত ৫ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ডাক্তার।
- সহযোগী স্টাফ:ফরেনসিক ল্যাব টেকনিশিয়ান, প্রশাসনিক সহকারী ইত্যাদি।
২.২. যোগ্যতাসমূহ
- ডিগ্রি:এমডি/এফসিপিএস ফরেনসিক মেডিসিন।
- অভিজ্ঞতা:সার্জন হিসেবে কমপক্ষে ৫ বছর।
- নিয়োগ স্কেল:জাতীয় বেতন স্কেল ৬ষ্ঠ গ্রেড।
৩. দায়িত্ব
- আদালত, পুলিশ ও তদন্ত সংস্থার জন্য স্বতন্ত্র এবং নিরপেক্ষ মেডিকেল/ফরেনসিক/ডিএনএ/পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট প্রস্তুত করা।
- মামলা সংক্রান্ত সাক্ষ্য প্রদান ও কোর্টে উপস্থিত থাকা।
- ফরেনসিক ল্যাব ও পরীক্ষার প্রকল্প/নিয়ন্ত্রণ ও মান বজায় রাখা।
- প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে বিচারিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
৪. সুবিধা
- বিচার প্রক্রিয়ার গতি বৃদ্ধি – সাক্ষীর অভাবে মামলার স্থগিত থাকার সমস্যা হ্রাস।
- স্বাধীন ও নিরপেক্ষ রিপোর্ট – প্রশাসন বা রাজনৈতিক চাপ থেকে মুক্ত।
- বিশেষজ্ঞ ফরেনসিক দক্ষতা – উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন ডাক্তার দ্বারা রিপোর্ট প্রস্তুত।
- আইনি জটিলতা হ্রাস – সাক্ষ্য দিতে না পারার কারণে মামলা দীর্ঘায়িত হওয়ার সমস্যা কমবে।
৫. বাস্তবায়নের প্রাথমিক ধাপ
- বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন কর্তৃক নীতিমালা প্রণয়ন।
- ডিজি ও প্রথম ব্যাচের জুডিশিয়াল মেডিকেল অফিসারদের নিয়োগ।
- ফরেনসিক ল্যাব ও কার্যালয় স্থাপন।
- প্রশিক্ষণ ও মান নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম শুরু।
এই প্রস্তাবনা বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা, দ্রুততা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো মামলার স্বচ্ছতা ও দ্রুততা নিশ্চিত করা। এর মধ্যে ফৌজদারী মামলায় সবচেয়ে সমস্যা হয় মেডিকেল রিপোর্ট এবং ফরেনসিক প্রমাণের ক্ষেত্রে।
বর্তমানে মেডিকেল রিপোর্ট, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট এবং ফরেনসিক সার্টিফিকেটের জন্য আমরা সম্পূর্ণভাবে সিভিল সার্জন অফিসের ওপর নির্ভরশীল। আর ডি এন এ রিপোর্ট আসে সিআইডি ল্যাব হতে যা একমাত্র ঢাকায় অবস্থিত এবং ইতোমধ্যে হাজার হাজার মামলার স্যাম্পলের চাপে জর্জরিত।
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য এটি অবশ্যই যুগোপযোগী উদ্যোগ। একটি পেশাদার, স্বতন্ত্র এবং নিরপেক্ষ জুডিশিয়াল মেডিকেল সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করলে ন্যায্য বিচার দ্রুত নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
লেখক : অ্যাডভোকেট শামস আর্ক; জ্যেষ্ঠ আইন কর্মকর্তা (ইনচার্জ); দৈনিক প্রথম আলো।