দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এখন থেকে সরকারি অনুমতি ছাড়াই বিচারক ও সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে—এমনটাই বলা হয়েছে দুদক অধ্যাদেশ ২০২৫-এর খসড়ায়।
গত বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) উপদেষ্টা পরিষদের নীতিগত অনুমোদন পাওয়া খসড়াটিতে বলা হয়েছে, দুদক আইন-২০০৪ এর ৩২(ক) ধারা বাতিল করা হবে।
এই ধারায় বলা হয়েছিল, বিচারক বা সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার আগে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারা অনুসরণ বাধ্যতামূলক।
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারা অনুযায়ী, বিচারক বা সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে সরকারের পূর্বানুমতি ছাড়া কোনো আদালত তা গ্রহণ করতে পারবে না।
এই অধ্যাদেশে দুদক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের সুপারিশ প্রতিফলিত হয়েছে। প্রতিবেদনটি গত ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালে সংসদীয় কমিটির আপত্তি সত্ত্বেও তৎকালীন হাসিনা সরকার যে ৩২(ক) ধারা দুদক আইনে যুক্ত করেছিল, তা ‘বৈষম্যমূলক’ এবং কমিশনের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করেছে।
২০১৪ সালে উচ্চ আদালত এই ধারাটিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে তা বাতিলের নির্দেশ দেন।
দুর্নীতিবিরোধী কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে এই বিধান বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছেন। কারণ, এটি দুদকের ক্ষমতা ও স্বাধীনতা খর্ব করছিল।
খসড়া অধ্যাদেশকে স্বাগত জানিয়ে দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মঈদুল ইসলাম বলেন, ‘সরকার যদি ৩২(ক) ধারা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়, সেটা প্রশংসনীয়।’
তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের রায়ের পর থেকেই এই ধারা অকার্যকর ছিল। যদিও আইনে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে বহাল ছিল।
আরও পড়ুন : আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সেনা কর্তৃপক্ষের ওপর নির্ভরশীল নয়: প্রসিকিউশন
খসড়া অধ্যাদেশে দুদকের কাঠামোগত সংস্কারের প্রস্তাবও রয়েছে। কমিশনারদের মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে চার বছর করার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি বলা হয়েছে, তিনজন কমিশনারের অন্তত একজন নারী হতে হবে।
কমিশন গঠনের জন্য নির্বাচনী কমিটি পাঁচ সদস্য থেকে বাড়িয়ে সাত সদস্য করা হবে, যার নেতৃত্ব দেবেন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারক।
অন্য সদস্যদের মধ্যে থাকবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত একজন নারী বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি বা বিচার কমিশনের চেয়ারম্যান, স্পিকারের মনোনীত ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের একজন করে সংসদ সদস্য এবং অন্তত ১৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সুশাসন বা দুর্নীতিবিরোধী বিশেষজ্ঞ, যিনি রাষ্ট্রপতির মনোনয়নপ্রাপ্ত হবেন।
সংসদ বিলুপ্ত হলে কমিটি থেকে সংসদ সদস্যদের বাদ দেওয়া হবে বলে খসড়ায় উল্লেখ রয়েছে।
কমিটি গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে আবেদন ও মনোনয়ন চাইবে। প্রার্থীদের সম্পদ বিবরণী ও জীবনবৃত্তান্ত জমা দিতে হবে। প্রয়োজনে কমিটি নিজ উদ্যোগেও যোগ্য প্রার্থী খুঁজে তাদের সাক্ষাৎকার নিতে পারবে।
যোগ্য প্রার্থীর কমপক্ষে ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে আইন, শিক্ষা, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নিরীক্ষা, আইন-শৃঙ্খলা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা দুর্নীতিবিরোধী কাজে।
অন্য দেশে স্থায়ী নাগরিকত্ব বা বসবাসের অনুমতি, কিংবা অনুমোদনহীন বিদেশি বিনিয়োগ থাকলে তারা অযোগ্য বিবেচিত হবেন বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে।
দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘খসড়া অধ্যাদেশটি বর্তমান আইনের চেয়ে উন্নত সংস্করণ। তবে সংস্কার কমিশনের কিছু কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ বাদ দেওয়া হয়েছে।’
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, কমিশনার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও কমিশনের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সংস্কার কমিশন ‘সিলেকশন অ্যান্ড রিভিউ কমিটি’ গঠনের প্রস্তাব করেছিল। সরকার শর্টলিস্ট করা প্রার্থীদের নাম প্রকাশের বিধানটিও বাদ দিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘দুদকের কার্যক্রমে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ছয় মাস পরপর কর্মদক্ষতা মূল্যায়নের যে প্রস্তাব ছিল, সেটিও বাদ দেওয়া হয়েছে।’
আরও পড়ুন : প্রতিষ্ঠার দ্বারপ্রান্তে বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয়: রেজিস্ট্রার জেনারেল সুপ্রিম কোর্ট
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এই নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, ‘কমিশনারের সংখ্যা তিনজন থেকে বাড়িয়ে পাঁচজন করার প্রস্তাবও উপেক্ষা করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, বাদ দেওয়া এসব সুপারিশ প্রায় সব রাজনৈতিক দলের সমর্থন পেয়েছিল। ‘তারপরও সরকার ইচ্ছামতো সেগুলো বাতিল করেছে। কারণ, সরকারের কিছু অংশ এসব বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করে।’
‘সংস্কারবাদী হিসেবে পরিচিত হতে চাওয়া সরকারের জন্য এটি হতাশাজনক ও সংস্কারবিরোধী নজির। সরকার নিজেই সংস্কার কমিশন গঠন করেছে এবং জাতীয় ঐকমত্যের আহ্বান জানিয়েছে, আবার নিজেই সেগুলো উপেক্ষা করেছে,’ যোগ করেন তিনি।
খসড়া অধ্যাদেশে আরও বলা হয়েছে, যেখানে দুদকের কার্যালয় আছে, সেসব জেলায় বিশেষ জজ আদালত স্থাপন করা হবে।
দুদক কোনো জেলায় অফিস স্থাপন করলেই সেখানে বিশেষ আদালত গঠন করা হবে। জেলা কার্যালয়গুলো প্রাথমিকভাবে অভিযোগ যাচাই করতে পারবে এবং কোনো অভিযোগ একবার যাচাই হয়ে গেলে তা পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন হবে না।
অধ্যাদেশে দুদকের এখতিয়ার বিস্তৃত করে দেশের বাইরে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিকদের দুর্নীতির পাশাপাশি বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকদের দুর্নীতিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এতে ‘জ্ঞাত আয়’ বলতে বৈধ আয়কে বোঝানো হয়েছে এবং দুদকের ক্ষমতা আরও বিস্তৃত করে মামলা দায়ের, তদন্ত ও অনুসন্ধানের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
সূত্র : ডেইলি স্টার

