মাসুদুর রহমান : দেনমোহর বা মহর ইসলামী বিবাহ প্রথার একটি অপরিহার্য অংশ, যা ইসলামের দৃষ্টিতে নারীর প্রতি সম্মান, মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তার প্রতীক। পবিত্র কুরআন শরীফে স্পষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, বিবাহের সময় স্বামীকে স্ত্রীর প্রতি নির্দিষ্ট অঙ্কের মহর প্রদান করতে হবে। ইসলামের মূল উদ্দেশ্য ছিল এই যে, নারী যেন বিবাহের মাধ্যমে কেবল সামাজিকভাবে নয়, আর্থিকভাবেও একটি সুরক্ষা পায়।
কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশি সমাজে এই মহরের ধারণা ক্রমশ বিকৃত হয়ে পড়েছে। মহর এখন অনেক ক্ষেত্রে ধর্মীয় দায়িত্ব বা অধিকার হিসেবে নয়, বরং সামাজিক প্রতিযোগিতা ও মর্যাদার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে, মহরের মূল দর্শন যেখানে ছিল সরলতা, বাস্তবতা এবং নারীর আর্থিক অধিকার নিশ্চিতকরণ, সেখানে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে সামাজিক প্রতিযোগিতা, বাহাদুরি এবং কৃত্রিম সম্মানের প্রতীক।
বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হওয়ায় এখানে বিবাহের ক্ষেত্রে ইসলামী বিধানই প্রাধান্য পায়। তবে সমাজের পরিবর্তিত বাস্তবতায় অনেক সময় ধর্মীয় বিধানকে পাশ কাটিয়ে সামাজিক রীতিনীতি প্রভাব বিস্তার করে। মহর নির্ধারণের ক্ষেত্রে সেটিই বেশি পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানে মহরের অঙ্ক নির্ধারণ অনেক সময় বাস্তবতার চেয়ে বহুগুণ বেশি ধরা হয়, যাতে পরিবার ও সমাজের চোখে মর্যাদাবান হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করা যায়।
বিশেষ করে ধনী পরিবারগুলো নিজেদের সামাজিক অবস্থান প্রদর্শনের জন্য মহরের অঙ্ক বাড়িয়ে দেখাতে চেষ্টা করে। আবার মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোও সামাজিক লজ্জা এড়ানোর জন্য অবাস্তব পরিমাণ মহর নির্ধারণ করে, যদিও তারা জানেন যে বাস্তবে এই অর্থ আদায় করা প্রায় অসম্ভব। এভাবে মহর ধীরে ধীরে তার মৌলিক উদ্দেশ্য হারিয়ে সামাজিক প্রতিযোগিতার এক বিকৃত প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
প্রতিযোগিতা ও সামাজিক স্ট্যাটাস প্রতীক হিসেবে মহর
বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় মহর আজ এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। ইসলামী শরীয়াহ যেখানে মহরকে নারীর অধিকার, সম্মান এবং আর্থিক সুরক্ষার প্রতীক হিসেবে দেখেছে, সেখানে আধুনিক সমাজে মহরের অঙ্ক অনেকাংশেই পারিবারিক মর্যাদা ও সামাজিক অবস্থানের মানদণ্ডে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে উচ্চবিত্ত পরিবার এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে মহরের পরিমাণ নিয়ে এক ধরনের নীরব প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায়।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, একটি পরিবার তাদের মেয়ের বিয়েতে মহর নির্ধারণ করে কোটি টাকার অঙ্কে, যাতে সমাজে তাদের পরিবারের প্রতিপত্তি ও স্ট্যাটাস প্রকাশ পায়। সংবাদপত্রে প্রায়ই এমন খবর প্রকাশিত হয় যেখানে ধনী পরিবারের কনের মহর কয়েক কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যদিও বাস্তবে সেই মহর কখনোই আদায়যোগ্য নয়। এভাবে মহর একটি ধর্মীয় ও সামাজিক কর্তব্য থেকে সরে গিয়ে অর্থনৈতিক প্রদর্শনীর উপকরণে পরিণত হয়েছে।
মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর ক্ষেত্রেও মহর নিয়ে প্রতিযোগিতা কম নয়। অনেক সময় তারা সমাজে পিছিয়ে পড়তে না চেয়ে বা আত্মীয়-স্বজনদের সামনে মর্যাদা রক্ষার জন্য কল্পনাতীত মহর নির্ধারণ করে। উদাহরণস্বরূপ, একটি দরিদ্র পরিবারও তাদের মেয়ের বিয়েতে ১০ লাখ বা ২০ লাখ টাকার মহর নির্ধারণ করে, যদিও পাত্রের আর্থিক অবস্থার সঙ্গে তা একেবারেই অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
এই ধরনের অযৌক্তিক মহর কেবল কাগজে কলমে থেকে যায় এবং কখনোই কার্যকর হয় না। এতে নারীর অধিকারও ক্ষুণ্ণ হয়, কারণ বাস্তবতা হলো অধিকাংশ নারী পরবর্তীতে এই বিশাল অঙ্কের মহর আদায় করতে সক্ষম হয় না, কিংবা স্বামী তা পরিশোধ করতে পারে না। ফলে মহরের প্রকৃত উদ্দেশ্য নারীকে আর্থিক সুরক্ষা দেওয়া ব্যর্থ হয়।
আরও পড়ুন : বিচারক ও সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে আর অনুমতি লাগবে না দুদকের
দেনমোহরের সামাজিক প্রতিযোগিতা কেবল ধনী-গরিব বৈষম্য বাড়াচ্ছে না, বরং বিবাহ প্রক্রিয়াকে জটিল ও ব্যয়বহুল করে তুলছে। ইসলামের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিবাহকে সহজ করা, যাতে সমাজে নৈতিকতা রক্ষা হয় এবং নারী-পুরুষ বৈধভাবে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। কিন্তু আজ মহরের নামে এক ধরনের অদৃশ্য প্রতিযোগিতা নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করছে।
অনেকে মনে করছে যে বিয়ে একটি আর্থিক প্রদর্শনীর ক্ষেত্র, যেখানে মহরের অঙ্ক যত বেশি, পরিবারের সম্মান তত বেশি। এই প্রতিযোগিতার কারণে বিবাহের প্রকৃত উদ্দেশ্য বিকৃত হচ্ছে এবং এর ফলে অনেক যুবক-যুবতী আর্থিক অক্ষমতার কারণে বিয়েতে অনাগ্রহী হয়ে পড়ছে।
আরেকটি দিক হলো, অতিরিক্ত মহরের এই প্রতিযোগিতা অনেক সময় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি করে। স্বামী যখন জানে যে তার ওপর লাখ বা কোটি টাকার মহরের বোঝা চাপানো হয়েছে, তখন তা তার জন্য মানসিক চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। স্ত্রী বা তার পরিবার যদি ভবিষ্যতে মহরের দাবি করে, তবে স্বামী প্রায়শই তা পরিশোধে অক্ষম হয়। এর ফলে দাম্পত্য জীবনে বিরোধ, বিবাদ এমনকি বিবাহ বিচ্ছেদ পর্যন্ত ঘটে।
অনেক ক্ষেত্রে স্বামীরা এই মহরকে একটি অযৌক্তিক দাবি হিসেবে বিবেচনা করে এবং স্ত্রীকে অবমূল্যায়ন করে। এভাবে মহরের মূল উদ্দেশ্য নারীর সম্মান রক্ষা উল্টোভাবে নারীর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশে মহরের এই প্রতিযোগিতা আইনগত ব্যবস্থাকেও জটিল করে তুলছে। মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী, মহর একটি দেনার মতোই আদায়যোগ্য। কিন্তু যখন মহরের অঙ্ক লাখ বা কোটি টাকায় পৌঁছে যায়, তখন আদালতের জন্যও তা বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবে মহরের টাকা আদায়ের উদ্দেশ্যে স্ত্রী মিথ্যা যৌতুক মামলা দায়ের করে থাকেন। অনেক মামলা বছরের পর বছর চলতে থাকে, কিন্তু বাস্তবে মহর আদায় হয় না। ফলে নারীরা তাদের বৈধ অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়।
সমাধান ও প্রতিকারমূলক দিক
অতিরিক্ত মহর ও মিথ্যা যৌতুক মামলার সমস্যা দূর করতে হলে সমাজ, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, আইনপ্রণেতা এবং বিচার বিভাগ সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
প্রথমত, সমাজে মহরকে প্রতিযোগিতা বা মর্যাদার প্রতীক হিসেবে না দেখে, ইসলামী ও মানবিক দৃষ্টিতে স্ত্রীর নিরাপত্তা ও সম্মানের প্রতীক হিসেবে পুনর্ব্যাখ্যা করা জরুরি। ধর্মীয় নেতারা বিয়ের খুতবা বা শিক্ষায় মহরের প্রকৃত অর্থ ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করলে সাধারণ মানুষ বুঝবে অতিরিক্ত মহর নির্ধারণ ইসলামি অনুশাসনের পরিপন্থী এবং তা দাম্পত্য জীবনের স্থিতিশীলতায় বরং বাধা সৃষ্টি করে।
দ্বিতীয়ত, Family Court -এর অধীনে মামলাগুলোকে সহজ ও দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে যাতে মহর আদায়ের জন্য কেউ বেআইনি পথে না যায়। আদালতগুলোর উচিত মহরের দাবিকে যৌতুক মামলা থেকে স্পষ্টভাবে আলাদা করে দেখা এবং মিথ্যা মামলার প্রবণতা রোধে আইনজীবী ও বিচারক উভয়ের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
তৃতীয়ত, সরকারের পক্ষ থেকে গণসচেতনতা কার্যক্রম চালানো যেতে পারে যেখানে সাধারণ মানুষকে জানানো হবে যে, মহর যৌতুক নয়; মহর আদায়ের আইনি পথ হলো পারিবারিক আদালত, যৌতুক মামলা নয়। একই সঙ্গে, মিথ্যা মামলা দায়েরকারীদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ধারা ২১১ অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হলে এমন প্রবণতা কমে আসবে।
চতুর্থত, সমাজে “বড় মহর মানে বড় সম্মান” -এই ধারণা পরিবর্তন করতে হবে। ইসলাম যে বাস্তব, সাধ্যসাধ্য ও ন্যায়সংগত মহরের কথা বলেছে, সেটিকেই সামাজিক মানদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এজন্য ইসলামি চিন্তাবিদ, কাজী (Marriage Registrar), এবং স্থানীয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে একত্রে কাজ করতে হবে।
সবশেষে বলা যায়, অতিরিক্ত মহর আজ বাংলাদেশের সমাজে এক ধরনের স্ট্যাটাস সিম্বল (Status Symbol) হয়ে দাঁড়িয়েছে। কে কত বেশি মহর নির্ধারণ করতে পারে, তা দিয়ে পরিবারগুলো নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শন করে। অথচ ইসলামের শিক্ষা হলো বিবাহকে সহজ করা এবং মহরকে সামর্থ্য অনুযায়ী বাস্তবসম্মত রাখা। বর্তমান প্রতিযোগিতার ফলে কেবল বিবাহ জটিল হচ্ছে না, বরং সমাজে ভণ্ডামি, বৈষম্য এবং পারিবারিক অশান্তিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই সমাজকে এই প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে এসে মহরের প্রকৃত উদ্দেশ্যে ফিরে যেতে হবে।
লেখক : মাসুদুর রহমান; আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। E-Mail : masud.law22@gmail.com

