ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ:
রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদ বলতে ‘মানুষ অথবা সম্পত্তির বিরুদ্ধে জোরপূর্বক বলপ্রয়োগ এবং সহিংসতার মাধ্যমে একটি সরকার, বেসামরিক জনগণ অথবা এর কোন অংশকে কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে আতঙ্কিত ও বাধ্য’ করাকে বোঝায়। কোন রাজনৈতিক বিরোধীদলের উপর যখন এরূপ জোরপূর্বক বলপ্রয়োগ এবং সহিংসতা করা হয়, এটি অবশ্যই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিশেষ প্রভাব ফেলে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে অপসারণ করার উদ্দেশ্যে এসকল কাজ করা মানেই হোল গনতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করা এবং সমাজকে লজ্জাহীন স্বৈরতন্ত্রের হাতে সোপর্দ করা।
সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ, পল উইলকিনসন তার Terrorism and the Liberal State (London, Macmillam, 1986)- নামক বইয়ে রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে, রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্তু মূলত ‘বাছবিচারহীন’ ও ‘অনিশ্চিত’ হয়ে থাকে। উনি আরও ব্যাখ্যা করেছেন যে, যেহেতু কোন নির্দিষ্ট ব্যাক্তি রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদের লক্ষ্যবস্তু হন না সেহেতু কেউই রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদ থেকে নিরাপদ নয়। যে কেউ যে কোন মুহূর্তে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারেন।
‘অপরাধমূলক সন্ত্রাসবাদ’ থেকে ‘রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদ’ ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে কারণ রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদে সাধারণত একটি নির্দিষ্ট দর্শকশ্রেণীকে প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা করা হয়ে থাকে। রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদীরা মূলত একটি বৃহত্তর সম্প্রদায়ের (রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের) উপর দীর্ঘমেয়াদী ভয়, ভীতি ও হুমকি সৃষ্টি করতে চায়। পল উইলকিনসন দাবি করেন যে ‘রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড বেশি নিষ্ঠুর প্রকৃতির হয়ে থাকে, অনেকটা শটগান দর্শনের মত, গাড়ি বোমা, পেরেক বোমা, ডাবল বোমা ইত্যাদি বিভিন্ন উপায়ে বহু মানুষকে একসাথে মেরে ফেলাই যার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে’।
অপরাধ যেখানেই সংঘটিত হোক না কেন, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে অপসারণ করার উদ্দেশ্যে মারাত্মক রাজনৈতিক সহিংসতা এবং নৃশংস আক্রমন কখনোই বিচারের আওতামূক্ত থাকা উচিৎ নয়। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পরিবার ও সহযোগীদের নৃশংস ভাবে হত্যার ফলে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদের শিকার হয়েছিল। সেই নৃশংস হত্যার মাত্র একচল্লিশ দিন পর একটি Indemnity Ordinance (ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ) ঘোষণা করা হয় যার ফলে খুনিদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের আইনি ব্যবস্থা গ্রহন করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়। পরবর্তীতে এই অধ্যাদেশ অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয় এবং ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা’-র রায়ের মাধ্যমে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে জাতি বেড়িয়ে আসে এবং সমাজে আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা হয়।
রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদের নিকৃষ্ট উদাহরণ হোল যখন একটি রাষ্ট্র বা ঐ রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন সরকার তার রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী আচরণ শুরু করে। বিদেশী অথবা নিজের দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কর্তৃক এই ধরণের সন্ত্রাসবাদকে ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ’ আদতে খুবই হতাশাজনক। কেননা নাগরিকদের জীবন, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মূলত একটি রাষ্ট্রের প্রধান দায়ীত্ব। আর সেখানে কিনা রাষ্ট্র নিজেই নাগরিকদের জীবন, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা হরণ করে দানবের ভুমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে?
অবশেষে ১৪ বছর পর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় হলো! মামলার জীবিত ৪৯ আসামির মধ্যে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, মাওলানা তাজউদ্দিন, হানিফ পরিবহনের মালিক মোহাম্মদ হানিফসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
এছাড়াও মামলায় সরাসরি সংশ্লিষ্টতার দায়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে স্থাপিত ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল-১-এ রায় ঘোষণার সময় ৩১ জন আসামি আদালতে হাজির ছিল। মামলার পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত।
নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য ‘২১ শে আগষ্টের গ্রেনেড’ হামলা একটি রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদের নগ্ন উদাহরণ। ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট তৎকালীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সরকার বাংলাদেশের গনতন্ত্রকে অরাজনীতিকরণের জন্য তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা এবং দলের অন্যান্য সদস্যদের ওপর প্রানঘাতি হামলা পরিচালনা করে। আর শুধু তা-ই নয়, সেই বর্বর গ্রেনেড হামলার পরে তৎকালীন বিএনপি সরকার মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত উধাও করার সবোর্চ্চ চেষ্টা করে। একই সাথে গ্রেনেড হামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়াকে বিভ্রান্ত করার জন্য মিথ্যা রাজনৈতিক নাটকও সাজায়। এ কারনেই ‘২১ শে আগষ্টের গ্রেনেড’ হামলা মামলার দীর্ঘ প্রতিক্ষিত রায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদকে রূখে দেয়ার জন্য এবং সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য অত্যন্ত জরুরী।
আবার, ‘২১ শে আগষ্টের গ্রেনেড’ হামলা মামলার রায় শুধুমাত্র বাংলাদেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়; বরং এই রায় দেশের সীমানা ছাড়িয়ে সমগ্র দক্ষিন-এশীয় রাষ্ট্র সমূহের জন্যও হয়ে উঠবে একটি দৃষ্টান্তমূলক উদাহরন। আমরা দেখেছি দক্ষিন-এশীয় রাষ্ট্র সমূহ নৃশংস রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের উর্বর আবাসভূমি। পাকিস্তানের লিয়াকত আলী খান হত্যাকাণ্ড (১৯৫১), মুহাম্মাদ জিয়াউল হক হত্যাকাণ্ড (১৯৮৮) অথবা বেনজির ভুট্টো হত্যাকাণ্ড (২০০৭), ভারতের মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী হত্যাকাণ্ড (১৯৪৮), ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ড (১৯৮৪) অথবা রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ড (১৯৯১), শ্রীলঙ্কাতে বান্দারনেয়েকে হত্যাকাণ্ড (১৯৫৯), ভিজায়া কুমারানাতুঙ্গা হত্যাকাণ্ড অথবা রানাসিংহে প্রেমাদাসা হত্যাকাণ্ড (১৯৯৩), ভূটানের জিগমে পালডেন দর্জি হত্যাকাণ্ড (১৯৬৪) অথবা মালদ্বীপের ড. আফরাশিম আলী হত্যাকাণ্ড (২০১২) ইতিহাসের পুনারাবৃত্তি ঘটিয়েছে বার বার। এর সবই ‘রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদের’ নগ্ন উল্লাস। সুতরাং, গণতান্ত্রিক সমাজ রক্ষায় ও এই সকল জঘন্য ধারাবাহিক রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদের সমাপ্তি ঘটাতে, প্রকৃত অপরাধীদের ও তাদের মদদ দাতাদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা অপরিহার্য।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও আইনের শিক্ষক