কেবল অনিয়ম, দুর্নীতি ও টেন্ডার-বাণিজ্যর মাধ্যমেই হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়ার অভিযোগ উঠেছে গণপূর্ত অধিদফতরের এক শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এই টাকায় দেশে-বিদেশে একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি অর্জন করেছেন বলেও অভিযুক্ত তিনি।
অভিযোগটি উঠেছে গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে। অন্য যে পরিচয়ে তাকে সবাই চেনেন, তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের যুদ্ধাপরাধীদের ‘গুরু’ মৃত গোলাম আযমের ভাগ্নে।
দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) এই ‘টাকার কুমির’র বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম সংক্রান্ত একটি দীর্ঘ লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন খোদ তার সহকর্মী অর্থাৎ গণপূর্ত অধিদফতরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।
গণপূর্তের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ঠিকাদারদের পক্ষে প্রকৌশলী ফজলে রাব্বী লিংকনের স্বাক্ষরিত এই অভিযোগ দুদকে জমা হওয়ার পর তা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখছে কমিশন।
এ বিষয়ে দুদক সচিব শামসুল আরেফিন গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা গণপূর্ত অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেওয়া লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। এখন তা যাচাই-বাছাই করা হবে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে তদন্ত শুরু হবে। প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে মামলা হবে।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম শিক্ষাজীবনে জামায়াতের ছাত্রসংগঠন শিবিরের রাজনীতি করতেন। পারিবারিক সূত্রে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের মাস্টারমাইন্ড গোলাম আযমের ভাগ্নে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় সংসদ সচিবালয়সহ ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিলেন তিনি। গোলাম আযমের সুপারিশে তৎকালীন সরকারের গণপূর্তমন্ত্রী মির্জা আব্বাসের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন হিসেবে গণপূর্ত অধিদফতর থেকে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা আয় করেন তিনি। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী ও কোরবানির ঈদে মির্জা আব্বাসসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গরু সরবরাহকারী হিসেবে গণপূর্ত অধিদফতরে তার ব্যাপক পরিচিতিও রয়েছে।
এদিকে অভিযোগের বিষয়ে গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। সাংবাদিক পরিচয়ে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েও তার সাড়া মেলেনি।
দুদকে জমা দেওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রধান প্রকৌশলীর পদটি বাগিয়ে নিতে রফিকুল ঘুষ লেনদেনও করেন। ২৫ কোটি টাকার বিনিময়ে বর্তমান পদে বসেছেন তিনি। এ সংক্রান্ত অভিযোগ পাঠানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও।
অভিযোগে রফিকুল ইসলামের এ অবৈধ লেনদেনে অনেক ‘রাঘব-বোয়াল’ জড়িত থাকার কথাও বলা হয়। একেবারে শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকটি পদের নাম উল্লেখ করে বলা হয়, টেন্ডার-বাণিজ্য করে প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ১ হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এক্ষেত্রে ‘শীর্ষ পর্যায়ের দুটি পদ’র কর্মকর্তা মালিক হয়েছেন যথাক্রমে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ও ২ হাজার কোটি টাকার। টেন্ডারে প্রধান প্রকৌশলী ৩ শতাংশ অর্থ সংগ্রহ করেন, আর ওই ‘দুই পদধারী’ও ২ শতাংশ করে অর্থ সংগ্রহ করেন।
লিখিত ওই অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, রফিকুল ইসলাম তিন মাস আগে সেই ‘শীর্ষ দুই পদধারী’র মধ্যে একজনকে তার স্ত্রীসহ বিদেশ নিয়ে যান। সেখানে কোটি টাকা দামের ডায়মন্ডের নেকলেস উপহার দেন ওই ‘শীর্ষ পদধারী’র স্ত্রীকে।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, বর্তমানে গ্রেড-১ পদে পদোন্নতি পেতে রফিকুল ইসলাম ওই ‘দুই শীর্ষ পদে’ যথাক্রমে ২০ কোটি এবং ১০ কোটি টাকা দিয়ে ডিও লেটার (সরকারি চাহিদাপত্র) নিয়েছেন। অর্থ বিনিময়ের মূল উদ্দেশ্য কমপক্ষে আরও দুই বছর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া। এমনকি পুনরায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে রফিকুল কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকা নিয়ে মাঠে নেমেছেন।
এতে আরও বলা হয়, রফিকুল ইসলামের আশীর্বাদপুষ্ট সৈয়দ মাহফুজ আহম্মদ ও এস এম ফজলুল কবির সম্প্রতি ২ বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন।
দুদকে জমা দেওয়া ওই অভিযোগে দাবি করা হয়, কানাডায় অবস্থানরত ছেলের মাধ্যমে বিদেশে ডলার পাঠাতে সহযোগিতা না করায় গণপূর্ত অধিদফতরের ই/এম সার্কেল-৩ এর (শেরে বাংলা নগর অঞ্চল) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল হাসেমকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও মানসিক নির্যাতন করায় তিনি প্রধান প্রকৌশলী রফিকুলের রুমেই স্ট্রোক করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। বিষয়টি চিৎকার করে হাসেমের স্ত্রী হাসপাতালের সবাইকে জানাতে চাইলে রফিকুল ইসলাম পেনশনের টাকা না পাওয়ার হুমকি দিয়ে হাসেমের স্ত্রীকে থামিয়ে দেন।
রফিকুলের বিরুদ্ধে কানাডায় নিকটাত্মীয়ের নামে বাড়ি কেনার তথ্য দিয়ে দুদকে দেওয়া ওই অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, রফিকুল ইসলাম তার প্রথম ঘরের স্ত্রীর ছেলে শাওনের মাধ্যমে হংকংয়ের এইচএসবিসি ব্যাংকে ২০০ কোটি টাকা জমা রাখেন। রফিকুলের নামে ঢাকায় একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি ও ফ্ল্যাট রয়েছে। ধানমন্ডির ৮ নং রোডে হাউজ নং-৯, রাজধানীর গ্রিন রোডের গ্রিন কর্নার নামের অ্যাপার্টমেন্টে আলিশান দু’টি ফ্ল্যাট, গুলশানের ৩৫ নং রোডে ৪৪ নং বাড়িতে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট এবং বনানীর ৭ নং রোডে এফ/১৭ আনোয়ার মঞ্জিল নামে একটি বাড়ি রয়েছে। এছাড়া মিরপুরে ১০ কাঠা জমির উপর ১২টি ফ্ল্যাট বিশিষ্ট ছয়তলা বাড়ির মালিকও তিনি।
অভিযোগে একটি বিল্ডার্সের মালিকের নাম উল্লেখ করে আরও বলা হয়, গণপূর্ত অধিদফতরের প্রতিটি বড় বড় কাজের টেন্ডার থেকে ‘নেগোশিয়েশন মানি’ হিসেবে প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম এবং ওই বিল্ডার্সের মালিক শত কোটি টাকা ভাগ বাটোয়ারা করেন। বাংলানিউজ