একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ভোট জালিয়াতি, কারচুপি, মৃত ব্যক্তির নামে ভোট দেওয়া ও কেন্দ্র থেকে এজেন্ট বের করে দেওয়াসহ বেশ কিছু যুক্তিতে মামলা করা হয়েছে। হাইকোর্টের নির্ধারিত নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালে দেশের বিভিন্ন আসনের পরাজিত অন্তত ৮০ জন প্রার্থী এসব মামলা করেন। মামলাকারীদের মধ্যে আছেন বিএনপি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলের (পিডিপি) প্রার্থীরা।
নির্বাচন নিয়ে কোনও প্রার্থীর অভিযোগ থাকলে তার প্রতিকার সংরক্ষিত রয়েছে সংসদ নির্বাচনের আইন বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও)। ফলে এ আইনের মাধ্যমেই প্রতিকার চেয়ে হাইকোর্টে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে প্রার্থীর। একইসঙ্গে এ আইনে হাইকোর্টকে প্রতিকার বিধানের ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে। ফলে আইন অনুসারে মামলার শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট তার ক্ষমতাবলে, সংশ্লিষ্ট আসনের বিজয়ী প্রার্থীর নির্বাচন বাতিল, বিজয়ী প্রার্থীর নির্বাচনের প্রক্রিয়া বাতিল করে আবেদনকারীকে (মামলাকারী) বিজয়ী বা অন্য কোনও প্রার্থীকে নির্বাচিত ঘোষণা করা কিংবা সংশ্লিষ্ট আসনের পুরো নির্বাচনি প্রক্রিয়া বাতিল করতে পারেন।
তাই প্রতিকার পেতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে অনিয়মগুলো হয়েছে তা তুলে ধরতেই এসব মামলা করা হয়েছে বলে মামলাকারীদের অন্যতম আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল গণমাধ্যমকে জানান। তিনি আরও বলেন, ‘মূলত এসব মামলায় সংশ্লিষ্ট আসনের বিজয়ী প্রার্থীদের নির্বাচনের প্রক্রিয়াগুলো আমরা আইনগতভাবে চ্যালেঞ্জ করেছি।’
এদিকে এসব মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতিটি মামলায় প্রার্থীদের নিজ নিজ আসনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘঠিত দুর্নীতি ও অনিয়মের ঘটনা বর্ণনা, ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের নামসহ তাদের পূর্ণ পরিচয় এবং ঘটনার সাক্ষীদের নাম ও তাদের পরিচয় বৃত্তান্ত তুলে ধরা হয়েছে।
এসব মামলার বিশেষ যুক্তি হিসেবে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে:
১. একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর এবং নির্বাচনি প্রচারণার শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দ্বারা হামলার শিকার হয়ে অনেক প্রার্থী তাদের নিজ নিজ এলাকায় প্রচারণা চালাতে পারেননি।
২. নির্বাচনের দিন প্রার্থীরা বিভিন্ন কারণে প্রতিকার চেয়ে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচনি কর্মকর্তাদের কাছে গেলেও কোন সঠিক ও কার্যকরী প্রতিকার পাননি।
৩. আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা তাদের কর্মী ও সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে বিএনপি প্রার্থীদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছেন।
৪. আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে ভোটারদের মনে ভোট দেওয়া নিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। যার ফলে ভোট দিতে আসার বিষয়ে ভোটাররা ভীত সন্ত্রস্ত ছিলেন।
৫. গত ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের আগের রাতেই সব কেন্দ্রে জাল ভোটের মাধ্যমে ব্যালট বাক্স ভরাট ও ৩০ ডিসেম্বর সকালে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে ভীতি প্রদর্শন করে।
৬. সকল ভীতি অতিক্রম করেও ৩০ ডিসেম্বর ভোট দিতে এসে অনেকেই ব্যালট পেপার পাননি বা ব্যালট পেলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছে।
৭. নির্বাচনের দিন প্রার্থীদের এজেন্ট বের করে দেওয়ার সময় পুলিশ কিংবা নির্বাচনি কর্মকর্তারা কোনও কার্যকরী ভূমিকা পালন করেননি।
৮.উপরোক্ত কারণে দেশের প্রধান দুইটি দলের প্রার্থীদের মধ্যে যে ভোটের ব্যবধান হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। কেননা, বিগত জাতীয় নির্বাচন বিবেচনায় এটাই পরিলক্ষিত হয়েছে যে, এবারের নির্বাচনে অনেক প্রার্থী অনেক কেন্দ্রেই শতভাগ ভোট পেয়েছেন, যা বিভিন্ন আসনের নির্বাচনি কর্মকর্তাদের ফলাফল শিটে প্রমাণিত।
তাই মামলাকারী ৮০ জন পরাজিত প্রার্থী তাদের নিজ নিজ এলাকায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাতিল চেয়ে মামলার আবেদন করেছেন।
নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালে মামলাকারীদের অন্যতম আইনজীবী ব্যারিস্টার এ কে এম এহসানুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গত ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে কী কী দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে, তা আদালতের সামনে তুলে ধরা হবে। তবে আদালতের মাধ্যমে ওই অনিয়ম ও দুর্নীতিগুলো জনগনের সামনে তুলে ধরাই হলো আমাদের নির্বাচনি মামলাগুলোর প্রধান উদ্দেশ।’
তবে মামলাগুলো শুনানি করতে আদালতে তোলার বিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানা গেছে। খুব শীঘ্রই মামলাকারীদের সকল আইনজীবী এ বিষয়ে একসঙ্গে বসে কে কোন মামলা পরিচালনা করবেন সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন বলেও আইনজীবীদের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে।
নির্বাচনি এসব মামলায় অনেক মৃত ভোটারের নামে ভোট দেওয়ার প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবী সগির হোসেন লিওন। তিনি বলেন, ‘মামলাগুলোতে আমরা সংশ্লিষ্ট আসনের বিজয়ী প্রার্থীর নির্বাচন পুরোপুরিভাবে অবৈধ ঘোষণার আবেদন জানিয়েছি। মামলা সংক্রান্ত অনেক প্রমাণাদি আমাদের কাছে রয়েছে। যা মামলার শুনানিতে আমরা আদালতের সামনে তুলে ধরবো।’ বাংলা ট্রিবিউন