জেল থেকে কোনো দিন যদি ছাড়া পান এহসান হাবিব, চলে যাবেন মা আর প্রতিবন্ধী ছোট বোনের কাছে। নড়াইলের কালিয়া থেকে এই মা–ই তো তাঁকে অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। সব স্বপ্ন ভেঙে গেছে। কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারে এখন শুধু নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে দিন কাটে এহসানের।
এহসান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে পুলিশ তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। এহসান বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানে, তিনি নিরপরাধ। তবু পরিস্থিতি শান্ত করার নামে তাঁকে বলির পাঁঠা বানিয়েছে। কারাগার থেকে লেখা খোলা চিঠিতে কীভাবে কী হলো, তার বিবরণ দিয়েছেন তিনি। তিনি লিখেছেন, ‘জেলখানা থেকে বেরিয়ে ফিরে যাব মায়ের কাছে। তারপর আম্মু, আমি আর প্রতিবন্ধী বোন—তিনজনে মিলে সুইসাইড করব।’
খোলা চিঠিতে এহসান লিখেছেন, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা সাতটা–আটটার দিকে ক্যাম্পাসের সামনে থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর বাসার নিচে গ্যারেজ না থাকার কারণে চার মাস ধরে ক্যাম্পাসের নতুন ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিংয়ের জায়গায় বাইক রাখেন। তাই সেদিনও ক্যাম্পাসে বাইক রাখতে এসেছিলেন। সে সময় তাঁর সঙ্গে দেখা হয় রুমমেট জি এম শোভনের সঙ্গে। এক কাপ চা খেয়ে ফেরার কথা ছিল তাঁদের। হঠাৎ তাঁদের সামনে উপস্থিত হন একজন সহকারী প্রক্টর। তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় একদল পুলিশ এসে আটক করে নিয়ে যান তাঁদের। কী কারণে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তার কোনো কারণ ব্যাখ্যা করেনি পুলিশ। পরে থানায় গিয়ে জানতে পারেন, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি শাখা ছাত্রলীগের সংঘর্ষের ঘটনায় কমিটি বিলুপ্ত হয়েছে। ক্যাম্পাসে নতুন পদপ্রত্যাশীরা বিজয় মিছিল ও বিলুপ্ত কমিটির পোস্টার ছিঁড়ে ফেলে। সে কারণে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বারবার পুলিশকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। নির্দোষ হলে পুলিশ তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার আশ্বাস দেয়। পরে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) মওদুদ হাওলাদার আটকদের ক্যাম্পাসে আসার কারণ জানতে চেয়ে নাম, ঠিকানা জেনে যাচাই করে দেখার কথা বলেন। পরদিন সকালে তাঁদের ছবি তোলেন। বেলা একটার দিকে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে জানিয়ে আদালতে চালান করে দেওয়া হয়। এ সময় প্রক্টরের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করেছিলেন এহসান। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি।
এহসান বলছেন, যেদিন ঘটনাটি ঘটেছিল, সেদিন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের সঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে বাইক রেজিস্ট্রেশন নাম্বার এবং গ্লোবাল ইনস্যুরেন্স থেকে বাইকের ইনস্যুরেন্স করার জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিলেন। গ্রেপ্তারের সময় এ কাগজগুলো তাঁর পকেটেও ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রক্টরকে এহসান তাঁর অভিভাবক হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘সন্তানের জীবন যেন এভাবে নষ্ট না হয়ে যায়। মামলা দেবার আগে একটাবার হলেও একটু দেখে নিবেন বৃহত্তর স্বার্থে কোনো নিরীহ ছাত্র যেন কখনো বলির পাঁঠা না হয়ে যায়।’
নড়েচড়ে উঠেছে প্রশাসন
এহসানের এই চিঠি ব্যাপকভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর নড়েচড়ে উঠেছে প্রশাসন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়ন সংসদ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিরপরাধ শিক্ষার্থী এহসানের মামলা প্রত্যাহার এবং সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করা না হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলে জানিয়েছে।
আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, এ বিষয়ে আজ রোববার তারা এহসানের জামিনের বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে।
এহসানের স্থানীয় অভিভাবক শামীম আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এহসান ছাড়া তাঁর পরিবারে উপার্জনের আর কেউ নেই। তাঁর মা নড়াইল–১ ও ২ আসনের সাংসদদের কাছে এহসানের বিষয়ে কথা বলেছেন। তাঁরা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। দ্রুত এহসানের জামিন এবং মুক্তির জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) মওদুদ হাওলাদার বলেন, মামলায় গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীদের আরও গভীরভাবে তথ্য–উপাত্ত নেওয়া হচ্ছে। যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যাবে, অভিযোগপত্রে তাঁদের নাম দেওয়া হবে। যাঁদের প্রমাণ হবে না, তাঁদের দায়মুক্তি দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে প্রক্টর নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘এহসানের বিষয়ে আমরা আন্তরিক। আগামীকাল তার জামিনের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তার সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে রাজনীতির সাথে কোনো সম্পৃক্ততা না থাকলে মামলা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা নেব।’