কাজী শরীফ:
একটা সংবাদ পড়ে গত কয়েকদিন ধরে মনটা খুব বিক্ষিপ্ত। ফেঞ্চুগঞ্জের সহকারী কমিশনার (ভূমি) সঞ্চিতা কর্মকারকে দিদি বলে ডাকায় তিনি লাথি মেরে এক মাছ বিক্রেতার মাছের ঝুড়ি রাস্তার পাশের নালায় ফেলে দেন! সংবাদের বিস্তারিত বর্ণনায় বলা হয়েছে তার অফিসের সামনে মাছ বিক্রি করতে বসলে তিনি মাছ বিক্রেতাদের সরে যেতে বলেন। তাদের মধ্যে লায়েক আহমেদ নামীয় একজন মাছ বিক্রেতা ‘দিদি সরিয়ে নিচ্ছি’ বলার পর তিনি উত্তেজিত হয়ে ‘আমি কিসের দিদি’ বলেই মাছের ঝুড়িতে লাথি মেরে তা পার্শ্বস্থ ডোবায় ফেলে দেন।
ঘটনাটা বারোই মে’র। পত্রিকায় আসে তেরোই মে। গত চারদিন নিজের মনকে অনেকভাবে শান্ত রাখার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে অবশেষে কিছুটা লিখছি। আমি যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখন আই এম এফ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যয় নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলো। তাতে বলা হয়েছিলো বাংলাদেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর পেছনে রাষ্ট্রকে ভর্তুকি দিতে হয় বছরে এক লক্ষাধিক টাকা! তার মানে আমার পেছনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে রাষ্ট্র ভর্তুকি দিয়েছে পাঁচ লক্ষাধিক টাকা!
আমাদের শুরুর দিকে মাসিক বেতন ছিলো ১২ টাকা। শেষদিকে ২০ টাকা করায় ছাত্র আন্দোলনও দেখেছিলাম। চাকসুর ক্যাফেটেরিয়ায় মাত্র ৮ টাকা দিয়ে পোলাও মুরগি খেয়েছি,মাত্র ১ টাকায় পরোটা কিংবা দুই টাকায় চা খেয়েছি। হলফ করে বলতে পারি এ দাম শুনে স্বয়ং শায়েস্তা খান বেঁচে থাকলে তারও চোখ কপালে উঠতো!
আমরা এসব সুবিধা পেয়েছি কারণ রাষ্ট্র আমাদের পেছনে ভর্তুকি দিয়েছিলো। এখনও যা দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র প্রায় একই রকম।
প্রশ্ন উঠতে পারে রাষ্ট্র তো জীব নয়। রাষ্ট্র হাঁটে না,হাসে না,নিদেনপক্ষে কথাও বলেনা! তবুও কীভাবে রাষ্ট্র এ ভর্তুকি দেয়? রাষ্ট্র দেয় তার নাগরিকদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ কর নিয়ে। মজার ব্যাপার কী জানেন? আমরা যারা নিজেদের উঁচুতলার মানুষ বলে দাবি করি, স্যার ডাক না শুনলে যাদের পায়ের পাতা থেকে মাথার তালু পর্যন্ত গরম হয়ে যায়, আমাদের লাথি গিয়ে পড়ে যেসব মাছ বিক্রেতার ঝুড়িতে তারা কিন্তু আয়কর আইনজীবীর কাছে যাননা!
আপনি বলতে পারেন করযোগ্য সীমায় তিনি উপার্জন করেন না কেনো যাবেন? আপনার আমার মত অধিকাংশ উঁচুতলার মানুষ আয়কর আইনজীবীদের কাছে কেনো যায় জানেন? রাষ্ট্রকে কর দিতে নয় কীভাবে কত কম দেয়া যায় সে পরামর্শ নিতে!
আর যে দরিদ্র, খেটে খাওয়া মানুষ আপনাকে, আমাকে স্যার ডাকেনা বলে আমরা কুন্ঠিত হই, যারা আমাদের সামনে আগেকার যুগে রাজার সামনে দাঁড়ানো প্রজার মত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়ায় কিংবা যাদের সামনে আমরা এক এক জন জমিদার সেজে বসে থাকি তারা কিন্তু কর ফাঁকি দিতে জানেনা। তারা পরোক্ষ করের আওতায় পড়ে ঠিকই তার প্রদেয় দান করে। এভাবে ক্ষুদ্র বালুকার কণা, বিন্দু বিন্দু জলের ঘামে আমাদের বছরে চার লাখ হাজার কোটি টাকার বাজেট হয়।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমরা যিনিই যে অফিসে চাকুরি করি তারা প্রতিষ্ঠানের নিয়মানুযায়ী উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে স্যার ডাকবো। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষ, যিনি চাকুরিতে আমার অধ:স্তন নন তার কাছে কোন বিবেচনায় ও কোন আইনে আমি স্যার ডাক শোনার প্রত্যাশা করবো?
আমরা কী বঙ্গবন্ধুর চেয়েও বড়! জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কিংবদন্তি সাংবাদিক এ বি এম মুসা ‘মুজিব ভাই’ নামে একটা বই লিখেছিলেন। চিন্তা করা যায় বাংলাদেশের জাতির জনককে নিয়ে লেখা বইয়ে তাকে ডাকা হয়েছে ভাই! আমি ভাবছি এখনকার অনেক স্যার ডাক শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে থাকাদের মধ্যে কাউকে নিয়ে আজ থেকে বহু বছর পর কেউ এরকম বই লিখলে শুধু বইয়ের নামকরণে দিদি বা ভাই লেখার কারণে না জানি কতদিন লেখককে চৌদ্দশিকের ভেতর থাকতে হয়!
আজ থেকে বেশ কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী লীগের তৎকালীন এক তৃণমূল নেতার পাঠানো চিঠির খাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বদৌলতে দেখার সুযোগ হয়েছিলো। সেখানে খামের উপরে ঠিকানার জায়গায় লেখা – প্রাপক, মুজিব ভাই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
যিনি না জন্মালে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হতোনা তিনি যদি ভাই হতে পারেন আমি আপনি কী!
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালে জয়দেবপুরে শ্রমিকদের সমাবেশে সরকারি চাকুরিজীবীদের উদ্দেশে বলেন ‘আপনি চাকুরি করেন আপনার মাইনে দেয় ঐ গরীব কৃষক, আপনার মাইনে দেয় ঐ গরীব শ্রমিক, আপনার সংসার চলে ঐ টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলেন, ওদের ইজ্জত করে কথা বলেন।’
সরকারি চাকুরিজীবীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু আরো বলেন ‘মনে রাখবা এটা ব্রিটিশ কলোনী নয়, এটা পাকিস্তান কলোনী নয়, যে লোককে দেখবা তার চেহারা তোমার বাবার মত, তোমার ভাইয়ের মত। ওরাই সবচেয়ে সম্মান বেশি পাবে। কারণ ওরা নিজে কামাই করে খায়।’
শিক্ষিত ভাইদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞাসা করেন- ‘আমাদের লেখাপড়া করায় কে? আমাদের ডাক্তারি পাশ করায় কে? আমাদের ইঞ্জিনিয়ার করে কে? আমাদের সায়েন্স পাশ করায় কে? আমাদের বৈজ্ঞানিক করে কে? আমাদের অফিসার করে কে? কার টাকায়? উত্তরে বঙ্গবন্ধুই বলে দেন – বাংলার জনগণের টাকায়।’
যে জনগণের প্রতি লাথি দিলেন তার আঘাত কোথায় গিয়ে পড়েছে বুঝতে পারছেন?
আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবো আমার শরীরে কৃষকের রক্ত। বাংলাদেশের এমন একজন মানুষও পাওয়া যাবেনা যার গায়ে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের রক্ত নেই। হয় আমাদের বাবা কৃষক ছিলেন, নচেৎ আমাদের দাদা কৃষক ছিলেন অথবা আমাদের পরদাদা কৃষক ছিলেন। যে দরিদ্র বাংলাদেশে বাস করে, জনগণের টাকায় পড়ে জনগণের টাকায় প্রদত্ত বেতন পেয়ে আপনি,আমি বিচারক,ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার, বিসিএস ক্যাডার হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছি, তাদের মুখে দিদি ডাক শুনে লাথি মেরে তাদের রুটি রুজির পাত্র নালায় ফেলে দিচ্ছি তারা কী আদতেই আমাদের এমন ব্যবহারের যোগ্য?
বঙ্গবন্ধু মাটির কাছাকাছি যেতে পেরেছিলেন বলেই তিনি বঙ্গবন্ধু। আসুন আমরাও সবাই সে প্রচেষ্টা করি। মনে রাখবেন- ‘যত বড় হোক ইন্দ্রধনু সে সুদূর আকাশে আঁকা আমি ভালোবাসি মোর ধরণীর প্রজাপতিটির পাখা।’ মানুষের ভালোবাসা পেতে হলে ইন্দ্রধনু হওয়ার চেষ্টা করলে আখেরে অহমিকা ছাড়া কিছুই অর্জন হবেনা। প্রজাপতির পাখা হতে পারলে মানুষের ভালোবাসা পেয়ে সত্যিকারের মানুষ হওয়া যাবে।
এই আমরা সরকারি কর্মচারীরা যে কথায় কথায় বঙ্গবন্ধুর চেতনা বাস্তবায়নের কথা বলি সেটা কেবল বক্তৃতার শোভা বাড়ানোর জন্য যেনো না বলি। আমরা যেনো তা মন থেকে ধারণ করি। তাহলে দিদি বললে আর লাথি দিতে ইচ্ছা করবে না, দিদির জবাবে ভাই বলে হাসিতে ভরে উঠবে আপনার আমার মুখ। ঠিক সে সময়েই হেসে উঠবে বাংলাদেশের মানচিত্র ও বঙ্গবন্ধু।
লেখক- সহকারী জজ, নোয়াখালী।