দ্রুততম সময়ে অপরাধীদের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় সমাজে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে বলে মনে করেন হাইকোর্ট। এ সংক্রান্ত এক রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ধর্ষণ বিশেষত শিশু ধর্ষণ ও পরবর্তীতে হত্যার মতো ঘৃণ্য অপরাধ বেড়েই চলেছে। এ অপরাধের সঙ্গে জড়িত অপরাধীর দ্রুততম সময়ে বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারার দায় মূলত রাষ্ট্রের ওপরই বর্তায়। এ ক্ষেত্রে বিচার বিভাগও জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নয়।
বগুড়ার একটি শিশু ধর্ষণ মামলার আসামির জামিনসংক্রান্ত আপিল নিষ্পত্তি করে দেওয়া রায়ের পর্যবেক্ষণে এমন মন্তব্য করেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে দায়েরকৃত মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তিতে ছয় দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
গত ১৮ জুলাই বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ থেকে ঘোষিত এ রায়ের অনুলিপি গতকাল সোমবার (১৯ আগস্ট) সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ পেয়েছে।
এক নম্বর নির্দেশনায় বলা হয়েছে, দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ধর্ষণ ও ধর্ষণপরবর্তী হত্যা মামলাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আইনে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে যাতে দ্রুত সম্পন্ন করা যায়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের সব ধরনের আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া যাচ্ছে।
দ্বিতীয় নির্দেশনায় বলা হয়, ট্রাইব্যুনালগুলোকে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২০ ধারার বিধান অনুসারে মামলার শুনানি শুরু হলে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি কর্মদিবসে একটানা মামলা পরিচালনা করতে হবে।
তৃতীয় নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ধার্য তারিখে সাক্ষীর উপস্থিতি ও সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য প্রতি জেলায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন), সিভিল সার্জনের একজন প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটরের সমন্বয়ে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করতে হবে। পাবলিক প্রসিকিউটর কমিটির সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকবেন এবং কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কে প্রতি মাসে সুপ্রিমকোর্ট, স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠাবেন। যেসব জেলায় একাধিক ট্রাইব্যুনাল রয়েছে, সেসব জেলায় সব ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটররা মনিটরিং কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হবেন। তাদের মধ্যে যিনি জ্যেষ্ঠ, তিনি সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবেন।
চতুর্থ নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ধার্য তারিখে রাষ্ট্রপক্ষ সঙ্গত কারণ ছাড়া সাক্ষীকে আদালতে উপস্থিত করতে ব্যর্থ হলে মনিটরিং কমিটিকে জবাবদিহি করতে হবে।
পঞ্চম নির্দেশনা হলো- মনিটরিং কমিটি সাক্ষীদের ওপর দ্রুত সময়ে যাতে সমন জারি করা যায়, সে বিষয়টিও তদারকি করবেন।
ষষ্ঠ নির্দেশনায় বলা হয়, ধার্য তারিখে সমন পাওয়ার পর অফিসিয়াল সাক্ষী যেমন ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, ডাক্তার বা অন্যান্য বিশেষজ্ঞ সন্তোষজনক কারণ ছাড়া সাক্ষ্য প্রদানে উপস্থিত না হলে ট্রাইব্যুনাল ওই সাক্ষীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ এবং প্রয়োজনে বেতন বন্ধের আদেশ প্রদান বিবেচনা করবেন।
বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে ৩৯৯ শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধর্ষণের পর একজন ছেলে শিশুসহ ১৬ শিশু মারা গেছে। এ ছাড়া চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে ৬৩০ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে প্রতিবেদন দিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। এ সময় ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৭ নারীকে। ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে ১০৫ নারীর ওপর। সারাদেশে ৯৫টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন এ ধরনের মামলার সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার। এর মধ্যে প্রায় ৩৭ হাজার মামলা পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে বিচারাধীন। অথচ আইনে বিচার শুরুর ৬ মাসের মধ্যে এসব মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার কথা। এমনই এক পরিস্থিতিতে গত ১৮ জুলাই ধর্ষণ মামলার তিন আসামির জামিন আবেদনের ওপর রায় প্রদানকালে হাইকোর্ট ছয় দফা নির্দেশনা দেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, আমাদের অভিজ্ঞতা হলো ধর্ষণ মামলার আসামিরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেপরোয়া ও ধূর্ত প্রকৃতির। এরা ভিকটিম ও তার পরিবারের ওপর চাপ-প্রভাব বিস্তার করে সাক্ষ্য প্রদানে ভয়-ভীতি, প্রলোভনসহ বিভিন্ন ধরনের কূটকৌশল অবলম্বন করে। ক্ষেত্রবিশেষে সালিশের নামে সামাজিক বিচার করে ভিকটিম ও তার পরিবারকে মামলা প্রত্যাহারে বাধ্য এবং আদালতে সাক্ষ্য প্রদানে বিরত থাকার জন্য চাপ প্রয়োগ করে থাকে। এ অবস্থায় সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়নের বিকল্প নেই। আমরা প্রত্যাশা করছি, সরকার দ্রুততম সময়ে এ বিষয়ে আইন প্রণয়ন করবে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ধর্ষণ ও ধর্ষণপরবর্তী হত্যাসহ নারী এবং শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলাগুলো বিচারের জন্য অপেক্ষমাণ। এর মধ্যে ৪/৫ বছরের পুরনো মামলার সংখ্যাও কম নয়। অভিযোগ গঠনে বিলম্ব এবং যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া ধার্য তারিখে রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষী উপস্থিত না হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক কয়েক মাস পরপর তারিখ পড়ছে। যদিও এ আইনের ২০ (৩) ধারায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, মামলা বিচারের জন্য নথিপ্রাপ্তির তারিখ হতে ছয় মাসের মধ্যে বিচারকাজ সমাপ্ত করার। এ ছাড়া শুনানি শুরু হলে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি কর্মদিবসে বিচার পরিচালনার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু এ নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ ও প্রতিপালন হচ্ছে না। বিচার বিলম্বের জন্য ট্রাইব্যুনাল, পাবলিক প্রসিকিউটর ও সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাকে সুপ্রিমকোর্ট এবং সরকারের কাছে লিখিতভাবে ব্যাখ্যা প্রদানের নির্দেশনা থাকলেও সমন্বয়হীনতার কারণে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতা দৃশ্যমান নয়। এ কারণে ছয় দফা নির্দেশনাসমূহ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে রায়ের অনুলিপি ট্রাইব্যুনালের সব বিচারকের কাছে পাঠাতে বলা হয়েছে।