অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: কবির চৌধুরী সরকারী চাকুরে। অবসরে গিয়ে একখন্ড জমি কিনে ছোট্ট আবাসন গড়ার স্বপ্ন দেখেন। তিল তিল করে জমানো ভবিষ্যৎ তহবিলের টাকা দিয়ে একখন্ড জমি কেনেন। ১২ বছর ধরে শান্তিপূর্ণভাবে ভোগদখল করে আসছিলেন। হঠাৎ একদিন তিনি শুনতে পেলেন একই গ্রামের জোতদার শফিক মিয়া জমিটি কিনে নিয়েছে এবং শিগগিরই তিনি তার লোকজন নিয়ে জমিটি দখল করতে আসবেন। কবির চৌধুরী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলেন জোতদার শফিক মিয়ার কাছে। তিনি সাফ জানিয়ে দেন এ জমি তার বাবা কিনেছিলেন এবং শফিক তার বাবার একমাত্র সন্তান হিসেবে জমিটির মালিকানা লাভ করেছেন এবং এখানে কারও কোনো অধিকার নেই। কবির চৌধুরী স্পষ্ট বুঝতে পারেন শফিকের ওই জমিটিতে কোনো বৈধ স্বত্ব নেই। কিন্তু চৌধুরী সাহেব তবুও চিন্তিত কারণ শফিক সমাজের দুষ্ট শ্রেণির মানুষ। বিবাদ করাই তার স্বভাব। ভাবতে ভাবতেই তিনি শরণাপন্ন তার এক পরিচিত আইনজীবীর কাছে। আইনজীবী তাঁর সমস্যার আইনগত সমাধান দেন।
চৌধুরী সাহেবের সামনে মূলত তিনটি পথ খোলা আছে। শফিক জমিটি দখল করতে এলে তাকে তাড়িয়ে দিতে পারেন যার অধিকার আইন তাকে দিয়েছে; অথবা শফিক কর্তৃক চৌধুরী সাহেব উৎখাত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে পারেন। বেদখল হওয়ার পর আদালতে গিয়ে মামলা করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে আদালতের সিদ্ধান্ত নিজের পক্ষে পেলে পুনরায় জমিটি দখল করবেন অথবা শফিকের আস্ফালন স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য চৌধুরী আদালতে যেতে পারেন এবং আদালতের সামনে পুরো ঘটনা উপস্থাপন করে নিজের স্বত্ব ও অধিকারের দলিলাদি উপস্থাপন করে আদালতের তাৎক্ষণিক আশ্রয় প্রার্থনা করতে পারেন। ঘটনার সব অবস্থা বিবেচনা করে আদালত শফিকের ওই জমিতে প্রবেশ করতে নিষেধ করে আদেশ দিতে পারে, যা আইনে ‘ইনজাংশন’ বা ‘নিষেধাজ্ঞা’ নামে পরিচিত।
আরও সহজ ভাষায় বলতে গেলে, কোন কিছু করা হতে মামলার পক্ষগণকে বিরত রাখা বা মামলা করার পর কোন পক্ষের করা কাজের জন্য পরিবর্তিত কোন সম্পত্তিকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনাকে ইনজাংশন বা নিষেধাজ্ঞা বলে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার কোন পক্ষের কর্মকান্ডে যদি মামলার সম্পত্তি নষ্ট হয়ে যায় বা কোন পরিবর্তন আনা হয় তবে মামলা নিস্পত্তির পর প্রতিকার দেয়া সম্ভব হয় না। তাই নিষেধাজ্ঞা জারির মাধ্যমে মামলা সংশ্লিষ্ট সম্পত্তি অপরিবর্তিত রাখা যায়। অবশ্য সরকারী উন্নয়নমূলক কাজের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষের কথা না শুনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা যায় না। করলেও এক সপ্তাহের বেশী অনিষ্পন্ন রাখা যায় না।
মামলায় জড়িত কোন পক্ষ কর্তৃক মামলা সংশ্লিষ্ট সম্পত্তি বিনষ্ট, ধ্বংস বা হস্তান্তর হওয়ার আশংকা দেখা দিলে অথবা কোন ডিক্রি জারির দরুন বেআইনিভাবে বিক্রয় হওয়ার উপক্রম হলে অথবা বিবাদী তার পাওনাদারকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে তার সম্পত্তি অপসারিত বা হস্তান্তরিত করার ইচ্ছা প্রকাশ বা হুমকি প্রদর্শণ করলে আদালত অনুরূপ কাজ রোধ করার জন্য অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ দিতে পারেন।
নিষেধাজ্ঞার প্রধানত দুই প্রকার হতে পারে। যথাক্রমে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা ও অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা। স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা অনন্তকালের জন্য চলতে পারে। মামলার রায় চূড়ান্ত আদেশ হওয়ার পর এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, রহিম মিয়ার জমির উপর দিয়ে আজিজ মোল্লা জোর করে রাস্তা বানাতে চায়। এখানে কখনও রাস্তা ছিল না। এই জমি পৈত্রিকসূত্রে মালিক রহিম মিয়া। মামলা করে আদালত থেকে রহিম মিয়া স্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ পেতে পারে যে, তার জমির উপর দিয়ে রাস্তা বানানো যাবে না।
অন্যদিকে মামলা চলাকালীন সময়ে বিবাদী যাতে মামলার বিষয়বস্তু হস্তান্তর বা কোন প্রকার রূপান্তর ঘটাতে না পারে সেই জন্য মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বিবাদীকে এই কাজ হতে বিরত থাকার জন্য সাময়িকভাবে যে আদেশ দেয়া হয় তাকে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা বলে। মামলা চলাকালীন কোন নির্দিষ্ট সময় বা মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সময়ের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। একটি সীমায়িত সময়ের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় এই জন্য এই নিষেধাজ্ঞকে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা বলে। অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা পাওয়ার জন্য কোন আলাদা মামলা দরকার হয় না। কোন মামলা করা থাকলে পার্শ্ব প্রতিকার হিসাবে ইনজাংশনের দরখাস্ত দিয়ে শুনানি করে ইনজাংশন পাওয়া যায়। আাদালতের নিকট যদি প্রতীয়মান হয় যে, মামলার বিষয়বস্তু বিনষ্ট বা ধ্বংসের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বা বিবাদী পাওনাদারকে প্রতারনা করার উদ্দেশ্য সম্পত্তি হন্তান্তর করার ইচ্ছা বা হুমকি প্রদান করেছে তাহলে আদালত উক্ত বিতর্কিত বিষয়বস্তু সংরক্ষনের জন্য বাদীর বা বিবাদীর আবেদনক্রমে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করতে পারে। মামলা নিষ্পত্তিতে সহায়তা করার জন্য এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। অপরপক্ষে সুখে শান্তিতে ভোগ দখল করার জন্য স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়।
অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আবার দু’ধরনের হতে পারে-(ক) মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত (খ) মামলা চলাকালীন কোন নিদিষ্ট তারিখ পর্যন্ত। আজকাল আদালতে বহুল প্রচলিত ‘স্টাটাসকু’ এক ধরনের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা।
অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার বৈশিষ্ট্য
ক) নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর বা নামঞ্জুর করার ক্ষমতা সম্পূর্ণ আদালতের সুবিবেচনার উপর নির্ভরশীল। তবে এই ক্ষমতা প্রয়োগের সময় আদালতকে পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় আনতে হবে।
খ) অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা একটি নৈতিকতামূলক প্রতিকার।
গ) অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা সম্ভাব্য অপূরনীয় ক্ষতি নিবারণমূলক ব্যবস্থা।
ঘ) আদালতে বিবেচনাধীন মামলার ক্ষেত্রেই শুধু অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে।
ঙ) প্রার্থীত নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে আবেদনকারীর কিছু ব্যক্তিগত স্বার্থ থাকতে হবে।
চ) নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকাকালীন তা অবশ্যই মেনে চলতে হবে।
অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার মূলনীতি
ক) বাদীকে প্রাথমিকভাবে একটি কেস প্রমাণ করতে হবে।
খ) নিষেধাজ্ঞা প্রার্থনা না-মঞ্জুর করলে বাদীর অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে।
গ) বাদীর অনুকূলে নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করলে তার বৃহত্তর সুবিধা হবে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৬ ও ৩৭ অনুচ্ছেদে মানুষের চলাফেরার স্বাধীনতা ও সমাবেশের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাঁধা নিষেধ সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, এর যে কোন স্থানে বসবাস ও বসতিস্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পূনঃপ্রবেশ করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে- যা সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদে ষ্পষ্ট করে বলা আছে।
অপরদিকে সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে যে, জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হওয়ার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।
সংবিধানে এসব কিছু বলা সত্ত্বেও গণউপদ্রব নিবারণকল্পে বা শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে ম্যাজিষ্ট্রেটকে কিছু নির্দেশ দেওয়ার অধিকার দিয়েছে। এগুলো মানুষের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী নয়, বরং মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষনের সহায়ক। ম্যাজিষ্ট্রেট যখন বুঝতে পারেন যে, গণ-উপদ্রব গুরুতর আকার ধারণ করতে যাচ্ছে অথবা এমন মারামারি বা দাঙ্গা বেঁধে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে, সে অবস্থায় ম্যাজিষ্ট্রেট ১৪৪ ধার জারি করতে পারে।
অন্যদিকে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৪৫ ধারার মামলা শুধুমাত্র স্থাবর সম্পত্তি সংক্রান্ত ব্যাপারে বিরোধের ফলে উদ্ভূত শান্তি ভঙ্গের সম্ভাবনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। স্থাবর সম্পত্তি দখল এবং বেদখল এর কারণে ১৪৫ ধারার মামলা দায়ের করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। দখল ও বেদখলকে কেন্দ্র করে শান্তি শৃঙ্খলার অবনতি এমনকি রক্তারক্তি, খুন, জখমের সম্ভাবনা থাকে। এসব থেকে রক্ষা পেতে ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ১৪৫ ধারার মামলা দায়ের করা যায়। ২০০৭ সালে মাসদার হোসেন মামলায় বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পর থেকে ১৪৫ ধারার মামলা দায়ের ও বিচারের কর্মকান্ড নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত এর উপর অর্পণ করা হয়েছে। তবে ১৪৫ ধারায় মামলা দায়ের করতে হলে অবৈধভাবে বেদখল হওয়ার ২ মাসের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে, বেদখল হওয়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান থাকতে হবে, শান্তিশৃঙ্খলার অবনতি আশঙ্খা থাকতে হবে, মারামারি, ঝগড়া বিবাদ, রক্তারক্তির আশঙ্খা বিদ্যমান থাকতে হবে, সেইসাথে নিরংকুশ মালিকানা স্বত্ব বিদ্যমান থাকতে হবে।
তবে মনে রাখা উচিত যে দীর্ঘদিন বেদখলে থাকলে এবং সম্পত্তি দখলে না থাকলে ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ১৪৫ ধারার মামলা করা যায় না। সেক্ষেত্রে ডিক্লারেশন স্যুট করে টাইটল প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি আরও ষ্পষ্ট হয়ে উঠবে। রহিম মিয়া একটি বড় পুকুরের মালিক। সেখানে ভাল মাছ চাষ হয়। তার প্রতিবেশী লোকজনের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে ওই পুকুরের মাছের উপর। একদিন লোকবলে বলীয়ান হয়ে জোরপূর্বক পুকুরে মাছ ধরতে আসে। রহিম মিয়া বাঁধা দিলে তারা ভয়ভীতি ও হুমকি দিয়ে চলে যায়। তারা জনবলে বলিয়ান। যে কোন মুহুর্তে তারা জোরপূর্বক পুকুরের মাছ ধরতে পারে। রহিম মিয়া বাঁধা দিলে রক্তারক্তি হবে। এক্ষেত্রে রহিম মিয়া ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ১৪৫ ধারা মতে নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করিতে পারে।
কোন অবস্থায় আদালত অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারেন, তা ৩৩ ডিএলআরের ‘মজিবুর রহমান বনাম সিরাজউদ্দিন ব্যাপারী’ মামলায় মাননীয় আদালত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। ওই মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, ‘বাদী যদি তার দাবির সপক্ষে ন্যায্য এবং যুক্তিপূর্ণ মামলা প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ পাওয়ার জন্য যথেষ্ট হবে। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, নালিশি বিষয়বস্তুর সংরক্ষণ, নালিশি বিষয়বস্তুতে কোনো পক্ষের স্বত্ব আছে কিনা তা নির্ণয় এর উদ্দেশ্য নয়। বরং নালিশি বিষয়বস্তুর সংরক্ষণই মূল উদ্দেশ্য।’
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক দৈনিক ‘ইন্টারন্যাশনাল’। Email: seraj.pramanik@gmail.com