মঈদুল ইসলাম:
পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারে আটক বিচারাধীন অসচ্ছল বন্দীদের (হাজতি) তালিকা চেয়েছে সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি। তাদের মামলা নিষ্পত্তিতে সরকারি আইনগত সহায়তা দেবার উদ্দেশ্যে কারা মহাপরিদর্শকের কাছে এই তালিকা চাওয়া হয়েছে। কোয়াসমেন্টের (মামলা বাতিলের) দরখাস্তে হাইকোর্ট বিভাগের আদেশে ১৩ থেকে ২৪ বছর ধরে বিচার আটকে আছে এমন ১৮৯১টি ফৌজদারী মামলার খোঁজ পেয়ে মাননীয় প্রধান বিচারপতি সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ৩টি ডিভিশন বেঞ্চকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে এগুলো খুবই প্রয়োজনীয় এবং প্রশংসনীয় উদ্যোগ। বিচার আটকে থাকা এরকম দেওয়ানী মামলার সংখ্যাও নেহায়েত কম হবে না। সেগুলো এবং আটকে থাকা এরকম দেওয়ানী ও ফৌজদারী আপীল, রিভিশনগুলোও নিষ্পত্তির বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হবে বলে আশা করতে মন চায়। তবে, বিচারপ্রার্থীর বিচারালয়ে কম্বলে কী কাজ তা বিচারকর্মে আমার স্বল্পকালের ক্ষুদ্রজ্ঞানে বোধগম্য হচ্ছে না কিছুতেই। কম্বলের সাথে উচ্চাঙ্গ সংগীতের নাকি একটা সম্পর্ক আছে, যদিও তা রসিকতার (সুরের ব্যাপার, কিঞ্চিৎ রস তো থাকবেই)। সেই যে, ওস্তাদজি দু’চোখ মুদে বুঁদ হয়ে সুরের মায়াজাল বিস্তার শেষে যখন নিজের মূর্ছা ভেঙে চোখ খুললেন, দেখলেন তাঁর সামনে সব ফাঁকা, কেবল এক বুড়ি-মা খাড়া। ওস্তাদজি যে-কম্বলের ওপর বসা তা এই বুড়ি-মা’র এবং সেটা নেবার অপেক্ষাতেই তিনি এতক্ষণ আছেন, নইলে তিনিও যেতেন চলে।
এক জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির বিচারক মহোদয়গণ আদালতে দরিদ্র বিচারপ্রার্থীদের মাঝে কম্বল বিতরণ করছেন বলে ক্যাপশানসহ ছবি ছাপা হয়েছে পত্রিকায় (সমকাল, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০)। বিচারালয় থেকে কারাগারে গেলে অবশ্য কম্বল আসে – বঙ্গবন্ধুই বলেছেন, “থালা বাটি কম্বল, জেলখানার সম্বল”! কিন্তু, সেখানে এখন বন্দীসংখ্যা আর স্থানসঙ্কুলানের যে পরিসংখ্যান তাতে অনেকের ভাগেই কম্বলের টান পড়ার কথা। জেল-যাত্রার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে ঐসব বিচারপ্রার্থীদের আগাম কম্বল দেয়া হয়ে থাকলে বিবেচনা প্রসূতই হয়েছে বলতে হবে। এই কর্ম বিচারকর্ম বিভাগে বেশ সাড়া জাগিয়েছে মনে হচ্ছে, অনেক সদস্যকে ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমে শেয়ার করতে দেখা যাচ্ছে। এভাবে অনুপ্রাণিত হলেতো অনেক জেলা লিগ্যাল এইড কমিটি আগামী শীতের অপেক্ষায় হয়ত থাকবে না। গ্রীষ্মে ছাতা, বর্ষায় রেইন-কোট বিতরণ শুরু করে দেবে, এরমধ্যে শরৎ আর বসন্তের জন্যও কিছু একটা আবিষ্কার হয়ে যাবে! তাহলে তো অবস্থাটা দাঁড়াবে “হোটেল-ফের্তা মুন্সেফ ডাকছেন ‘মধুসূদন কংসারি’!/চট্ট চটির দোকান খুলে দস্তুরমত সংসারী।”(ডিএল রায়) এর মত ‘ভারি আশ্চর্যি’!
অসচ্ছল, অসমর্থ বিচারপ্রার্থীদের আইনগত সহায়তা দেবার বিধিবিধান করে ২০০০ সালে করা হয় ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন’। এ সহায়তার কাজ শুরু করা হয়েছিল ১৯৯৭ সালে একটি রিজলিউশন জারীর মাধ্যমে। ২০০০ সালে আইন করে আরও কার্যোপযোগী করা হয়েছে। বিধিমালা, নীতিমালা, প্রবিধান ইত্যাদিও এসেছে পরে পরে। আইনগত সহায়তা পাবার যোগ্যতা হিসেবে সহায়-সম্বলহীন হবার কথা আছে।সম্বলহীন কম্বলহীনও হতে পারে বটে। কিন্তু, আইনগত সহায়তার যেসংজ্ঞা তাতেকম্বলের স্থান দেখছিনা আইনে, বিধিতে, প্রবিধানে। এটা তহবিল তসরুফের পর্যায়ে পড়ে যায় কিনা সেটাই ভাবনা। এক কাজের সরকারি টাকা আরেক কাজে ব্যয়। তখন আর মহৎ উদ্দেশ্য টিকবে কিনা বলা মুশকিল।
এই কাজটিকে অভিনব এবং মহানুভব হিসেবে দেখছেন হয়ত কেউ কেউ। আমি কিন্তু এর মধ্যে কোন অভিনবত্বও দেখছি না, মহানুভবতাও দেখছি না। শীতার্তকে কম্বল দেয়া জেলার ত্রাণ কর্মকর্তার কাজ। কম-বেশির বিতর্ক থাকলেও তাঁরা তা করেন। বিচারের ঘরে মামলা ফেলে রেখে বিচারকের দেয়া কম্বলে বিচারপ্রার্থীর সেই ওম পাবার কথা নয়। নিজেকে বিচারপ্রার্থীর অবস্থানে ফেলে আমি অন্তত কোন ওম পাচ্ছি না। কম্বল পাবার জায়গা তার অনেক আছে, কোথাও না কোথাও তার তা জুটে যাবে। কিন্তু তার মামলার নিষ্পত্তি, ন্যায্য বিচার,বিচারকের কাছে ছাড়া আর কারো কাছে পাবার নেই। সেটা করে দিলেই কম্বলের চেয়েও বেশি ওম পাবে। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিই বিচারকের জন্য এখনকার সব চেয়ে বড় অভিনবত্ব এবং সেটাই দেখান জরুরী। আর যদি, সত্যি সত্যি আইনমত সঠিক বিচারটা করা যায়, তার চেয়ে বড় কোন মহানুভবতা বিচারকেরআর দেখাবার নাই।
বিচারক আর মামলার সংখ্যানুপাত, মামলা বৃদ্ধির ধারাপাত তো অজানা নয় কারও। অপরাধের ধরন বাড়ছে, নতুন আইন হচ্ছে। নতুন আদালত থাকছে কেবল সেই আইনের কালো অক্ষরে, বিচার থাকছে আগেকার আদালতেই। একই অঙ্গে বহু রূপ ধারণ করে একই ঘরে বিচার করতে হচ্ছে এক বিচারককেই। বাড়তি দায়িত্বেরবাড়তি ভাতাটুকুও নেই। গাভি থাকলে দুধ, ঘুঁটে তো পাওয়া যায়ই, নিরুপায় গরীব চাষি হাল চাষও করিয়ে নেয় – তাতে দুধও ঠিকমত হয় না, চাষও হয় না ঠিকমত। কিন্তু, আমাদের রাষ্ট্র তো আর সেই দীন-হীন অবস্থায় নেই এখন। বিচারের বেলায় গরিবিয়ানা এখন তার আর মানায় না। ঠিকমত বিচার দিতেরাষ্ট্রেরগরজ নিয়ে বেমক্কা প্রশ্ন তুলতে পারেন কেউ। এখানেখাল-নালা পেলেই যেমনময়লাফেলা হয় নির্বিচারে – সেখানে যা ফেলার নয় তাও,অনেকক্ষেত্রে তেমন করেই যা খুশি তাই মামলা ফেলা হয়আদালতে, চলুক না চলুক দেদারসে।লাখ নিষ্পত্তিতেও মামলা কমছে না। এ যেন সেই“ঠোঙাভরা বাদাম ভাজা খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না।” (সুকুমার রায়) অবস্থা।
প্রশ্ন আসতেই পারে, বিচারক ও আইনজীবীর নিজেদের মামলাও এরকম জটে আটকে থাকে কিনা! আমি অন্তত নিজেরটা বলতে পারি – না, থাকে না। আব্বার বিঘে দুই জমির অনেক দিনের ‘আধিয়ার’ (ভাগচাষি) হঠাৎ একদিন ভাগ দেয়া বন্ধ করে নিজের বলে দাবি করে বসে (পেছনে কারও ইন্ধন তো ছিলই)। তখন আমার চাকরির সবে শিক্ষানবিশকাল। মামলা করে দখল উদ্ধারের ডিক্রী পেতে কত সময়, কত ব্যয়, তারপরে ডিক্রীজারীতে আবার কত সময়, কত ব্যয়, আদালত দখল দিলেও দখল চালাতে লাগবেতো সেই আরেক আধিয়ার! তার চেয়ে এতদিনে ভাগে যা ধান পাওয়া গেছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকাই লাভজনক। এইসব ফিরিস্তি যখন দিলাম, ভাবী বিচারকের বাবা বুঝে গেলেন চট করে। দিলেন জমি ছেড়ে, আমিও বাঁচলাম পৈত্রিক সূত্রে মামলা প্রাপ্তি থেকে। আরও অনেক পরে, আমার বাসায় দু’বার চুরি হল, একবার পড়লাম ছিনতাইয়ে। প্রত্যেকবার পুলিশ আমাকে মামলার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে তদন্তে অপরাধীদের কিনারা করতে পারে নি বলে ফাইনাল রিপোর্ট দিয়ে। (খোয়া যাওয়া মালামালের আর্থিক মূল্য তস্কররা ছাড়া আর কেউ পাত্তা দিল না!)
বিচারের করুণাধারা বইবার স্রোত পাচ্ছে না মামলা ঠাসা আদালতে। তারপরে আছে পদে পদে উচ্চ আদালতে ছুট দেয়া, একটা স্টে-অর্ডার হলে ২৪ বছর পার। আইনজীবী থাকেন তো সাক্ষী আসে না, সাক্ষী এলে আইনজীবী আরেক আদালতে ব্যস্ত। হাজারো রকমের বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করার অভিনবত্ব, কলাকৌশল বিচারককেই দেখাতে হবে। এই বিরুদ্ধ স্রোতে বিচারের তরণি বাওয়ার তিনিই কাণ্ডারি। তাছাড়া, বলদ যে ঘানি টানে, সে তো কেবল খড়-বিচালির জন্য নয়, লাঠ্যাঘাতের ভয়টাও তো থাকে। আপনার কাছ থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে, আপনার ঘরে মামলা ফেলে রেখে বাঙালিকে কোর্ট দেখায় আপনাকে দিয়েই। বদনামির নন্দ ঘোস বিচারক! আসামি জামিনে কেন, আসামিতে কারাগার উপচায় কেন, এত বছর ধরে মামলা শেষ হয় না কেন, তলব পড়ে বিচারকের। মান বাঁচাবার দায় নিজেরই। যে মামলা আইনে চলে না তা যেন ঢুকতেই না পারে তা বাছাইয়ে বিচক্ষণতা আর কঠোরতা দেখাবার আছে। আইনজীবীসহ মামলার বিচারে সংশ্লিষ্ট সবার দরকারি সহযোগীতাটুকু আদায় করে নেবার দক্ষতা দেখাবার আছে। হুজুগে মাতা বিচারকের কাজ নয়। তখন আমি সিনিয়র সহকারী জজ, এক সহকর্মীর বিদায় অনুষ্ঠানে জেলা জজ বলেছিলেন, ‘‘বিচারককে মনে করতে হবে যেন তার পরনে সাদা পোশাক, যা তা করা যাবে না আর সবার মত। একটুতেই মলিন দাগ হয়, চোখে পড়ে সবার।” আসলেই, শুভ্রতার এ কৌলীন্য বজায় রাখতে হয় বিচারকের।
লেখক: সাবেক সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল); ই-মেইল: moyeedislam@yahoo.com