মিল্লাত হোসেন: বার কাউন্সিলের আইনজীবী সনদের লিখিত পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীদের উপর রক্তাক্ত হামলা, খাতা ছিঁড়ে ফেলা, গাড়িতে বসে খাতা লেখা, ভাঙচুরসহ সীমাহীন নৈরাজ্যের মুখে বর্তমানে প্রচলিত ত্রিস্তরের পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল করে যুগ ও পেশার উপযোগী করা বা পূর্বতন পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়ার বিষয়গুলো পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।
কোনো সংশয় নেই যে ওকালতি একটি গুরুশিষ্য পরম্পরার বিদ্যা। আবার, আইনপেশা কোনো চাকুরিও নয়, স্বাধীন ব্যবসা। বার কাউন্সিলের সনদ হলো তা পরিচালনার লাইসেন্সমাত্র।
ফলে এই সনদের জন্য জুডিসিয়াল সার্ভিস (বিজেএস) বা সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) কিংবা অপরাপর চাকুরি পরীক্ষার মতো প্রিলিমিনারি, লিখিত আর মৌখিক পরীক্ষার বন্দোবস্ত রাখা কতোটা যৌক্তিক- তা ভেবে দেখার দরকার আছে। পেশার উপযোগী কোনো পদ্ধতিই এক্ষেত্রে গড়ে তুলতে হবে।
এক্ষেত্রে, আগেকার দিনের পদ্ধতি কী ছিলো সেসব পাঠ করে বিনির্মাণ করার কথা ভাবা যেতে পারে। কী চমৎকারই না ছিলো সেটা!
ইংরেজ আমলে দু’টি মৌল আবশ্যকতার ভিত্তিতে জেলা আদালতে একজন আইনজীবী হিসেবে সনদ পাওয়ার বিধি তৈরি করা হয়েছিল।
প্রথমত, আইনজীবী সনদপ্রার্থীকে ০১ বছরের প্রতি কর্মদিবসে বিচারকাজের নির্ধারিত সময়টিতে আদালতে বাধ্যতামূলকভাবে উপস্থিত থাকতে হতো। হাজিরা খাতাটি জেলা ও দায়রা জজের রুমের পার্শ্বরুমে রাখা হতো এবং সনদপ্রার্থীদের সেখানে উপস্থিত হওয়ার সময় উল্লেখে হাজিরা খাতার নির্দিষ্ট ছকে স্বাক্ষর করতে হতো।
আদালতে বসার সময়ের ঠিক আগ মুহূর্তে জেলা ও দায়রা জজ সাহেব খাতাটি নিজ রুমে এনে যারা সেখানে স্বাক্ষর করেননি তাদের নির্ধারিত ছকে লাল কালিতে অনুপস্থিত লিখতেন।
আবার আদালতের বিচার কাজের নির্ধারিত সময় শেষে খাতাটি পার্শ্বরুমে রাখা হতো এবং আরেকটি নির্দিষ্ট ছকে আদালত ত্যাগের সময় উল্লেখে স্বাক্ষর করতে হতো এবং তা না করলে পূর্বের ছকে স্বাক্ষর করলেও সেদিন অনুপস্থিত ধরা হতো!
কেউ কোনো কারণে যতো দিন আদালতে অনুপস্থিত থাকতেন ঠিক সেই ক’টা দিন একই নিয়মে হাজিরা দেয়ার পর জেলা ও দায়রা জজ সার্টিফিকেট দিতেন যে- সনদপ্রার্থী এক বছর যাবৎ কর্মদিবসে আদালতে উপস্থিত থেকেছেন।
যেহেতু এই এক বছর বাধ্য হয়েই সকাল-বিকাল আদালতে উপস্থিত থাকতে হতো, সেহেতু জেলা ও দায়রা জজ আদালতসহ অধীনস্ত সকল আদালতে উপস্থিত থেকে সিনিয়র আইনজীবীরা কিভাবে সাক্ষীদের জবানবন্দি নেন কিংবা তাদেরকে জেরা করেন এবং কিভাবে সওয়াল-জবাব করেন কিংবা আপিলগুলোতে কিভাবে সওয়াল জবাব হয়;
এছাড়াও বিচারকগণ কীভাবে আদালত পরিচালনা করেন, আদালতের কার্যপদ্ধতি কী রকম হয় তা প্রথমদিকে বাধ্য হয়ে এবং পরে আগ্রহ নিয়েই হয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হতো সনদপ্রার্থীদের।
আবার, যে সিনিয়র আইনজীবীর সঙ্গে যুক্ত থাকতেন তাকেও সার্টিফিকেট দিতে হতো যে, সনদপ্রার্থী তার চেম্বারে নিয়মিত এক বছর যাবৎ শিক্ষানবিস হিসেবে উপস্থিত থেকেছেন।
এরপর এক মাস যাবৎ জেলা ও দায়রা জজ কর্তৃক স্বাক্ষরিত আদালতের নোটিশ বোর্ডে একটি বিজ্ঞপ্তি সাঁটা থাকতো, যাতে বলা হতো- সনদপ্রার্থীর বিরুদ্ধে নীতিঘটিত দুষ্টতার অভিযোগ কারো থাকলে সেটা জানাতে পারেন। উপর্যুক্ত শর্ত পূরণ হওয়া এবং নির্ধারিত ফিস দেয়ার পরে বার কাউন্সিল কর্তৃক জেলা আদালতের আইনজীবী সনদ দেয়া হতো।
চার বছর আইন ব্যবসা করার পর বিধি অনুযায়ী উপযুক্ত হওয়ার পর হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে সনদ পাওয়ার আবেদন করতে হতো এবং দুই জন বিচারপতির কাছে মৌখিক পরীক্ষা দিতে হতো।
তারপর সরকারি গেজেটে সাত দিন পর পর চারবার সনদপ্রাপ্তিতে প্রার্থী’র নীতিঘটিত দুষ্টতার কারণে কারো আপত্তি আহ্বান করে বিজ্ঞপ্তি ছাপা হতো এবং কোনো আপত্তি না পাওয়া গেলে নির্ধারিত ফিস প্রদানে হাইকোর্টের আইনজীবীর সনদ দেয়া হতো।
আইন পেশার যে আদালতকেন্দ্রীকতা ও গুরুশিষ্য পরম্পরার ঘরানা, তার সাথেও এই পদ্ধতি সামঞ্জস্যপূর্ণ। যে একটা কমন প্রশ্ন আসতে পারে তা হলো- এখনকার দিনে এতো শোভনপদ্ধতি কাজ করবে কী না?
বাস্তবে কোন পদ্ধতিই নিশ্ছিদ্র নয়। প্রয়োজনে আগের পদ্ধতিতে কিছু সংস্কার আনা যেতে পারে মূল কাঠামো ঠিক রেখে। সংশ্লিষ্ট বার ও বিচার প্রশাসনের নিজেদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠার পরিচয় দিতে হবে।
এর সাথে সাথে সনদপ্রাপ্তির জন্য বয়সসীমা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। সর্বোচ্চ ৩০-৩২ বছর বয়স পর্যন্ত জেলা আইনজীবী সনদ পাওয়ার আবেদন করা যাবে- এমন বিধান করলে “যাদের নেই কোন গতি” এমন লোকজন আর এলএলবি ডিগ্রি নিতে আগ্রহী হবেন না।
প্রকৃত শিক্ষার্থীরাই আইন পেশায়এ বিচার বিভাগে আসবেন। এছাড়া আইন শিক্ষাক্রমেও কিছু পরিবর্তন অনিবার্য। কারণ, একটা বিষয় তো নিশ্চিত যে- বর্তমান ব্যবস্থা আর চলছে না।
(তথ্যসূত্র: “ওকালতি ও জজিয়তি জীবনের জলছবি”-আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী ও কিছু অনলাইন সংবাদমাধ্যম।)
মিল্লাত হোসেন: যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ, সিলেট