সিরাজ প্রামাণিক: জমি কেনা-বেচার ক্ষেত্রে সাবধান না হলে পরবর্তীতে দীর্ঘদিন নানা ঝামেলা পোহাতে হয়। এমন বহু মানুষ রয়েছেন, জমি কেনা-বেচার ক্ষেত্রে আসল দলিল চিনতে না পারায় কোর্ট-কাচারী আর ভূমি অফিসে ঘুরতে ঘুরতে পেরেশান হয়ে গেছে। এজন্য দলিল চেনা খুবই জরুরি।
২০০৫ সালের ১লা জুলাইয়ের আগে রেজিস্ট্রিকৃত জমি নিয়ে জাল দলিলের বিরোধ বেশী দেখা যায়। বিশেষ করে কাউকে জমির মালিক সাজিয়ে জমি সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে অন্য কারও নামে রেজিস্ট্রি করে নেয়। তবে এর সাথে বরাবরই অফিসের কিছু অসৎ কর্মচারী ও একশ্রেনীর অসাধু দলিল লেখক জড়িত থাকে।
আবার অনেক সময় এজমালি সম্পত্তি ভাইয়েরা বোনদের না জানিয়ে বাটোয়ারা দলিল নিজেদের নামে করিয়ে নেয়। যেসব ক্ষেত্রে আদালত থেকে বণ্টননামা সম্পন্ন করা হয় না, সে ক্ষেত্রে দলিল জালের সম্ভাবনা বেশি থাকে।
অনেক সময় অপির্ত সম্পত্তি বা মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি জীবিত দেখিয়ে জাল করা হয়। অনেক সময় মালিক বিদেশে থাকলে তার নিকটাত্মীয়গণ জাল দলিল তৈরী করে দেখায় যে, বিদেশ যাওয়ার আগেই জমিটি তার কাছে বিক্রি করে গেছে।
অনেক সময় ঘষামাজা করে এবং ওভাররাইটিং বা কাটাছেঁড়া করেও দলিল জাল করতে পারে। আবার মূল তারিখ ঠিক রেখে দলিলের বিষয়বস্তু জাল করতে পারে।
জমির জাল দলিল সনাক্তের উপায়সমূহ নিম্নরূপ-
ভলিউমের তথ্য: রেজিস্ট্রি অফিসে সংরক্ষণ করা দলিলের সঙ্গে আপনার সন্দেহকৃত দলিলের সাল মিলিয়ে দেখুন। এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবর দলিলটির যাবতীয় তথ্য দিয়ে দরখাস্ত করতে হবে। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দলিলের প্রকৃতি অনুযায়ী চারটি রেজিস্ট্রার বা ভলিউমে সংরক্ষিত থাকে।
তবে মনে রাখুন জমি ক্রয়ের সময় বিক্রেতার কাছ থেকে সব দলিল, বিশেষ করে বায়া দলিল অর্থাৎ পীঠ দলিল চেয়ে নিতে হবে। এরপর সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে সব দলিলের ক্রমিক নম্বর, দলিল নম্বর মিলিয়ে নিন।
স্বাক্ষর যাচাই: কুচক্রী মহলের যোগসাজশে অনেকে স্বাক্ষর জালিয়াতি করে জমি বিক্রেতা বা গ্রহীতার ছদ্মবেশ ধারণ করে। এক্ষেত্রে হস্তরেখা বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে সত্যতা যাচাই করিয়ে নেয়া যেতে পারে। এছাড়া ভূমি অফিস থেকে বিভিন্ন সিল পরীক্ষা করেও জালিয়াতি নির্ণয় করা যায়।
সিল ও তারিখ যাচাই: খেয়াল রাখবেন পুরাতন দলিলে চিহ্নিত কিছু পুরাতন সিল ব্যবহার হয়ে থাকে। পুরাতন দলিলে সিল যদি নতুন হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে, দলিলটি জাল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
একই সঙ্গে তারিখটিও ভালোভাবে যাচাই করে নিন। দলিল রেজিস্ট্রির তারিখ যদি কোনো সরকারি বন্ধের দিন হয়, তাহলে সন্দেহের অবকাশ আরও প্রকট হয়ো স্বাভাবিক।
এক জমির একাধিক মালিক: একই জমি যদি একাধিক মালিকের নামে হয়ে থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে দলিলটি জাল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে সরেজমিনে গিয়ে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে মূল মালিক কে, তা নির্ণয় করতে চেষ্টা করুন।
নামজারি বা মিউটেশন: সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিস থেকে জমির মিউটেশন বা নামজারি সম্পর্কে খোঁজ নিতে পারেন। নামজারিতে ধারাবাহিকতা ঠিক আছে কি-না, সেটা ভালভাবে বুঝে নিন। যদি দেখা যায়, সিএস জরিপের সঙ্গে বিক্রেতার খতিয়ানের কোনো গরমিল আছে, তাহলে বুঝতে হবে, কোনো জটিলতা আছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, জরিপ খতিয়ানে জমির পরিমাণ পরবর্তী সময়ে যতবার বিক্রি হয়েছে, তার সঙ্গে জমির পরিমাণ মিল আছে কি। দাগ নম্বর, ঠিকানা এসব ঠিক আছে কি-না, মিলিয়ে নিন।
আমমোক্তারনামা বা পাওয়ার অব অ্যাটর্নি: সম্প্রতি কোনো আমমোক্তারনামা দলিল থাকলে তাতে উভয় পক্ষের ছবি ব্যবহার হয়েছে কি না কিংবা উক্ত আমমোক্তারনামা রেজিষ্ট্রিকৃত কি-না সঠিকতা যাচাই করে নিন।
দান করা জমির ক্ষেত্রে: জমিটি যদি দান করা হয় তাহলে দেখতে হবে জমির দলিল সম্পাদনের তারিখ থেকে কতদিন পর দানগ্রহীতা জমিতে দখলে গেছে। দান দলিলটি রেজিস্ট্রি করা কি না এবং দলিলদাতার সঙ্গে গ্রহীতার সম্পর্ক কী, কিংবা সম্পর্কের ভিত্তিতে তিনি দান গ্রহীতা হতে পারবেন কি-না এগুলো যাচাই করে নিন।
লেখক যাচাই: দলিলটি সম্পর্কে সন্দেহ হলে বিক্রীত দলিলের দলিল লেখকের নাম ঠিকানা জেনে সরেজমিন কথা বলুন। তাতে আপনার সন্দেহ দূর হয়ে যাবে।
স্ট্যাম্প যাচাই: দলিল সম্পাদনের সময় ব্যবহৃত স্ট্যাম্পের পেছনে কোন ভেন্ডার থেকে স্ট্যাম্প কেনা হয়েছে এবং কার নামে কেনা হয়েছে খেয়াল রাখুন। প্রতিটি স্ট্যাম্পের পেছনে একটি ক্রমিক নম্বর উল্লেখ থাকে। এ নম্বরটি ঠিক আছে কি না, প্রয়োজনে স্ট্যাম্প বিক্রেতার সঙ্গে দেখা করে যাচাই করে নিন।
জাল দলিল বাতিল করবেন কিভাবে
জাল দলিল সম্পর্কে অবগত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা বাতিলের জন্য দেওয়ানি আদালতে মামলা করতে হবে। এ ছাড়া তামাদি আইনের প্রথম তফসিলের ৯১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, জাল দলিল তৈরি সম্পর্কে জানার তিন বছরের মধ্যে এ মামলা করা যাবে।
অবশ্য এধরনের মামলা তামাদি হয়ে গেলে সুনিদির্ষ্ট প্রতিকার আইনের ৪২ ধারা অনুসারে ‘ডিক্লেরেশন মামলা’ বা ‘ঘোষণামূলক মোকদ্দমা’ দায়ের করে ভিন্নভাবে প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ আছে।
আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩৯নং ধারা হতে ৪১নং ধারা পর্যন্ত আদালত কর্তৃক দলিলাদি বাতিলীকরণ সম্পর্কে বলা হয়েছে। দেওয়ানি আদালতে মামলা দায়ের করা হলে বিচারক বিবাদীদের বিরুদ্ধে সমন জারি করবেন এবং বিস্তারিত শুনে সাক্ষীর মাধ্যমে মামলার নিষ্পত্তি করবেন। এ ক্ষেত্রে জাল দলিলটি আদালতে উপস্থাপন করে ভুয়া প্রমাণ করা যায়।
এছাড়া সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৪০ ধারা অনুসারে দলিল আংশিক বাতিলের মামলাও করা যাবে। দলিল বাতিলের সঙ্গে সম্পত্তির দখল পাওয়ার মামলাও করা যায়। আদালত দলিল বাতিলের আদেশ/রায় দিলে ডিক্রির একটি কপি সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে পাঠাতে হবে।
এরপর সেই কপির আলোকে রেজিস্ট্রি অফিস দলিল বাতিলের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বালাম বইতে লিপিবদ্ধ করে রাখবে। দলিল বাতিলের মামলায় কোর্ট ফি আইনের দ্বিতীয় তফসিলের ১৭(৩) অনুচ্ছেদে বর্ণিত কোর্ট ফি দিতে হবে। যার স্বার্থ আছে, তিনিই কেবল দলিল বাতিলের মামলা করতে পারবেন।
৩৯ ডিএলআর এ ‘সুফিয়া খানম চৌধুরী বনাম ফাইজুন্নেছা চৌধুরী মামলা’র সিদ্ধান্ত অনুসারে, কোনো দলিল রদের প্রার্থনা ছাড়াই শুধু ওই দলিল বাতিল মর্মে ঘোষণার মামলা চলতে পারে।
তবে যদি দেখা যায় যে, সুনিদির্ষ্ট প্রতিকার আইনের ৩৯ ধারা অনুসারে ওই দলিল রদের ঘোষণা দরকার কিন্তু এ ধরনের কোনো প্রাথর্না করা হয়নি, সে ক্ষেত্রে বাদীকে অতিরিক্ত কোর্ট ফি প্রদান করতে বলা হবে।
আবার জাল দলিল তৈরিকারীদের বিরুদ্ধে আপনি ফৌজদারি আদালতে দণ্ডবিধির ৪০৬/৪২০/৪৬৩-৪৭৩ ধারায় মামলা করতে পারেন। বিচারক চাইলে সেই মামলা সরাসরি আমলে নিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে সমন বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দিতে পারেন।
তাছাড়া মামলাটি তদন্তের জন্য পুলিশের বিভিন্ন সংস্থার কাছে পাঠাতে পারেন। তদন্তে দলিল ভুয়া প্রমাণিত হলে আসামিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডাদেশ দিতে পারবেন আদালত।
সিরাজ প্রামাণিক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন বিশ্লেষক, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com