ড. মো নায়ীম আলীমুল হায়দার: সম্প্রতি হাইকোর্টের একটি রায়ে নারীদের মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার হওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করায় বিতর্ক দেখা দিয়েছে৷ বর্তমানে এই বিষয়ে নান ধরণের মতামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মূলত আইন মন্ত্রনালয়ের একটি বিবাহ নিবন্ধক (প্রচলিত অর্থে কাজী) প্যানেল বাতিল করার পর সংক্ষুদ্ধ পক্ষ উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করেন। নিকাহ রেজিস্ট্রার হওয়ার জন্য সরকারি প্রজ্ঞাপনে তিনটি যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে:
১. সরকার স্বীকৃত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা মাদ্রাসা বোর্ডের নিবন্ধিত কোনো মাদ্রাসা থেকে কমপক্ষে আলিম সার্টিফিকেটধারী হতে হবে;
২. বয়স কমপক্ষে ২১ এবং সবোচ্চ ৪৫ বছর হতে হবে; এবং
৩. সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দা হতে হবে।
দিনাজপুরের ফুলবাড়িয়া পৌরসভার আয়েশা সিদ্দিকা ফাজিল পাশ৷ নিকাহ রেজিস্ট্রার পদে তিনি নিয়ম মেনেই আবেদন করেছিলেন৷ পরীক্ষাও দিয়েছেন৷ পরীক্ষায় তিনি হয়েছিলেন প্রথম৷ তারপরও তার নিকাহ রেজিস্ট্রার হওয়ার পথ আদালতের রায়ে আপাতত বন্ধ৷
মুসলিম বিবাহকে সাধারণত অন্যান্য ধর্মের বিবাহের মত ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের বিষয় হিসেবে দেখা হয় না। মুসলিম বিবাহকে একটি দেওয়ানী চুক্তি হিসেবেই গণ্য করা হয় এবং এই ধারণাটি বিভিন্ন ইসলামিক দলিলে আমরা লক্ষ্য করি। ইসলামিক আইন অনুযায়ী একটি মুসলিম বিবাহের জন্য কিছু মৌলিক উপাদান অবশ্যই থাকতে হয় তা হল প্রস্তাব, সমর্থন, বর ও কনের যোগ্যতা (বয়স, মানসিক সুস্থতা ও অন্যান্য কিছু বিষয়) এবং ২ জন যোগ্য সাক্ষী। মুসলিম বিবাহ একটি দেওয়ানী চুক্তি হবার পরও বাংলাদেশে আমরা বিবাহের সময় কিছু ধর্মীয় ও অন্যান্য রীতি বা আচার পালন করি। এই রীতি বা আচার আমাদের এখানে এক ধরণের প্রথা হিসেবে কাজ করে যদিও মুসলিম বিবাহের বৈধতার জন্য উক্ত রীতি বা আচার গুলো আবশ্যিক নয়। মুসলিম আইন অনুযায়ী বিবাহের নিবন্ধন কোন প্রয়োজনীয় বিষয় নয়। ভারতীয় উপমহাদেশে সর্ব প্রথম Bengal Muhammadan Marriages and Divorces Registration Act, 1876 এর মাধ্যমে মুসলিম বিবাহকে ইচ্ছামুলক নিবন্ধন করার একটি বিধান করা হয়। মূলত মুসলিম বিবাহ ও তালাকের বিষয়গুলো সংরক্ষণ ও হিসেব রাখার জন্যই এই বিধানটি করা হয়।
পাকিস্তান পিরিয়ডে মুসলিম বিবাহ নিবন্ধনের বিষয়টি আবার আলোচনায় আসে। তখনকার সরকার Muslim Family Law Ordinance 1961 (MFLO) চালু করেন। ১৯৫৬ সালের বিবাহ ও পারিবারিক আইন সম্পর্কিত একটি কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে উক্ত আইনটি চালু করা হয়। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম নারীদের অধিকার বৃদ্ধি ও অধিকার গুলোর সুরক্ষা প্রদান করা। উক্ত আইনের ৫ ধারায় মুসলিম বিবাহকে আবশ্যিক নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসা হয়। মূলত কিছু সমস্যা সমাধানের জন্যই এই বিধান চালু করা হয়। মুসলিম নারীদের বিবাহের প্রমাণ সংক্রান্ত সমস্যা, ভরণপোষণ ও উত্তরাধিকার সম্পর্কিত বিষয় গুলোর সমাধানের জন্য উক্ত নিবন্ধন প্রক্রিয়া খুবই সহায়ক ভুমিকা পালন করে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর The Muslim Marriages and Divorces (Registration) Act, 1974 প্রণয়ন করা হয়। উক্ত আইনের মাধ্যমে মুসলিম বিবাহ ও তালাক নিবন্ধন সংক্রান্ত বিষয় গুলো আরো বিস্তারিত ভাবে উঠে আসে। Muslim Family Law Ordinance 1961 (MFLO) এর ৫ ধারা এই নতুন আইনের মাধ্যমে বাতিল হয়ে যায় যদিও Muslim Family Law Ordinance 1961 (MFLO) এর অন্যান্য বিধিবিধান গুলো এখনো কার্যকর আছে।
উচ্চ আদালত উক্ত রিট পিটিশনটি মূলত দুইটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে নাকচ করে দিয়েছেন। প্রথমত, উচ্চ আদালতের মতে, নারীদের জন্য বিবাহ নিবন্ধকের পদটি খুবই কষ্টদায়ক, দূর দূরান্তে দুর্গম এলাকায় রাতের বেলায় যাওয়া আসা পুরুষদের মত সম্ভব নয়। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশে অনেক নারীরা নানা ধরণের কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং পদে চাকরি করছে। জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, সেনা বাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌ বাহিনী, সরকারী বিভিন্ন দপ্তর এবং বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরে নারীরা সম্মানের সাথে কাজ করছে। এছাড়া বাংলাদেশের অনেক নারী দেশের বাইরেও নানা ধরণের কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং পদে চাকরি করছে। তাই নারী নিবন্ধকের নিয়োগের ক্ষেত্রেও উক্ত বিষয় গুলো বিবেচনায় রাখা যেতে পারে। যে সব নারীরা নারী নিবন্ধকের চ্যালেঞ্জিং বিষয় গুলো মেনে নিয়ে এই পেশায় আসতে চায় তাদের জন্য সেই সুযোগ রাখা যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, উচ্চ আদালত বিবাহ নিবন্ধকের পদটিকে অন্যান্য সরকারী পদের সাথে মিলিয়ে ফেলতে চান নি। তাদের মতে মুসলিম বিবাহের ক্ষেত্রে প্রধানত বিবাহ নিবন্ধককে কিছু ধর্মীয় রীতি নীতি বা আচার পালন করতে হয় যা অন্যান্য সরকারী পদধারীদের করতে হয় না। কিন্তু The Muslim Marriages and Divorces (Registration) Act, 1974 এ বিবাহ নিবন্ধকের এই রূপ ধর্মীয় রীতি নীতি বা আচার পালনের দায়িত্ব বিষয়ে কিছু বলা হয় নি। আইনে বিবাহ নিবন্ধকের যোগ্যতা হিসেবে মাদ্রাসা থেকে আলিম পাশ করাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে একটি প্রথা হয়ে গিয়েছে যে, যিনি বিবাহ নিবন্ধন করবেন তাকেও বিবাহ সংক্রান্ত অন্যান্য ধর্মীয় রীতি নীতি বা আচার পালন করতে হবে। এটাও হয় যে, বিবাহ নিবন্ধক তার অফিস সহকারী কে বিয়ে পড়ানো ও ধর্মীয় অন্যান্য রীতি নীতি বা আচার পালনের জন্য পাঠালেন। আবার এটাও হয় যে, বিবাহের পক্ষগন যারা আছেন তারাই বিয়ে পড়িয়ে ফেললেন ও অন্যান্য আচার সম্পাদন করে বিবাহ নিবন্ধকের কাছে আসলেন বিবাহ নিবন্ধন করার জন্য। ১৯৭৪ সালের আইন ও ২০০৯ সালের বিধিতে বলা আছে যে, যদি বিবাহ নিবন্ধক বিয়ে পড়ান ও অন্যান্য আচার পালন করেন তাহলে সাথে সাথেই বিবাহ নিবন্ধন হয়ে যেতে পারে আবার বিয়ে যদি অন্য কেউ পড়ান তাহলে বিবাহের পক্ষদ্বয়কে বিবাহ নিবন্ধনের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিবাহ নিবন্ধকের কাছে আসতেই হবে।
উচ্চ আদালত আরো বলেছেন, বাংলাদেশের অনেক বিয়ে মসজিদে পড়ানো হয়। নারীদের প্রতি মাসের নির্দিষ্ট সময়ে একটি শারীরিক উপসর্গ (ঋতুচক্র ) দেখা দেয় এবং ওই সময় মসজিদে প্রবেশ করার অনুমতি নেই। নারীদের ঋতুচক্রকে বিবাহ নিবন্ধকের জন্য একটি শারীরিক অযোগ্যতা হিসেবে দেখানো হয়েছে। বিয়ে পড়ানো বা ধর্মীয় রীতি বা আচার পালন করা বিবাহ নিবন্ধকের আইনগত কর্তব্য নয়। ঋতুচক্র কালীন সময়ে নারী নিবন্ধক অন্য কোন ব্যাক্তিকে বা তার অফিসের কোন সহকারীকে বা মসজিদের ইমামকে বিয়ে পড়ানো এবং অন্যান্য রীতি বা আচার পালনের জন্য বলতে পারেন। ঋতুচক্র কালীন সময়ে নারী বিবাহ নিবন্ধক বিয়ে পড়ানো ও অন্যান্য আচার পালন থেকে বিরত থাকবেন। তিনি তখন শুধুমাত্র বিবাহ নিবন্ধন করবেন অন্য কিছু নয়। তাই ঋতুচক্রকালীন সময়কে বিবেচনায় নিয়ে নারী বিবাহ নিবন্ধকের পদটি নিয়ে ইতিবাচক ভাবে আগানো যায়।
আমাদের সংবিধান কিছু মৌলিক অধিকারকে নিশ্চিত করেছে, যেমন; আইনের চোখে সমতা, লিঙ্গের উপর ভিত্তি করে কোন বৈষম্য করা যাবে না, চাকরি বা পেশার ক্ষেত্রে কোন বৈষম্য করা যাবে না ইত্যাদি। হাইকোর্টই শেষ আদালত নয়৷ এরপর আপিল বিভাগ আছে৷ এরইমধ্যে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল ফাইল করা হয়েছে৷ আশা করা যায় উচ্চ আদালত সকল দিক (প্রচলিত আইন, সমঅধিকার ও ধর্মীয় দিক নির্দেশনা) বিবেচনা করে যুগোপযোগী একটি সিদ্ধান্ত দিবেন।
ড. মো নায়ীম আলীমুল হায়দার: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান; আইন ও বিচার বিভাগ, নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ