মো. শহীদুল্লাহ মানসুর: কোনো দেশ বা জাতির উন্নয়নে নারী ও পুরুষের সমানতালে কাজ করার বিকল্প নেই। দেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ অভাবনীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অথর্নীতিকে বেগবান করতে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে কমর্জীবী নারীরা নিত্যদিন নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হন। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হন কমর্জীবী মায়েরা। অফিস, সংসার ও সন্তান- একই সাথে সামলানো বেশ মুশকিল। অধিকাংশ কর্মজীবী নারীই মনে করেন, “মা হিসেবে সন্তানকে হয়তো আরেকটু বেশি সময় দেওয়া উচিত”। সন্তানকে বাসায় একা রেখে যাওয়া যেমন কষ্টের, তেমনি চিন্তা ও ভয় সন্তানের নিরাপত্তা ও যত্ন নিয়ে। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। শিশুরা যেখানেই থাকুক, যেভাবেই থাকুক না কেন, তাদের প্রতি যত্নবান হতে হবে। তা না হলে আগামীতে দেশের নেতৃত্ব ও সুনাগরিক হিসাবে শিশুদের গড়ে তোলা কঠিন হয়ে যাবে। সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিকে তথা নারীদের দিনের বেশিরভাগ সময় বাসার বাইরে অবস্থান করতে হয় এবং স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই বাইরে থাকার ফলে তাদের শিশুদের জন্য মানসম্পন্ন উপযুক্ত স্থানে নিরাপদ ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিচর্যার প্রয়োজন। এ কারণে শিশুদের জন্য শিশুদিবাযত্ন কেন্দ্র গড়ে তোলা প্রয়োজন যেখানে শিশুরা থাকবে নিরাপদে, বাবা বা মায়েরা কর্মক্ষেত্রে কাজ করবে নিশ্চিন্তে। এরই প্রেক্ষেপটে ১ সেপ্টেম্বর ২০২১, শিশুর নিরাপত্তা ও উপযুক্ত পরিবেশে যত্ন নিশ্চিতকল্পে শাস্তির বিধান রেখে ‘শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র আইন, ২০২১’ কার্যকর করেছে সরকার। আইনটি পর্যলোচনা করা যাক-
কার্যকারিতা
এই আইনের বিধানাবলী ততটুকুই কার্যকর হবে যতটুকু অন্য আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থাৎ অন্য কোন আইনের বিধান এই আইনের কোন বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হলে, এই আইনের বিধানটি কার্যকর হবে না। (ধারা-৩)
কেন্দ্রের নিবন্ধন
সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্বীয় ব্যবস্থাপনায়, নির্ধারিত শ্রেণির কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনা করতে পারবে তবে শুধুমাত্র ব্যক্তি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্যে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। সরকার প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ নিয়োগ করবে। কোন ব্যক্তি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালনা করতে চাইলে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নিবন্ধনের জন্য নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ বরাবর আবেদন করবে। আবেদন পর্যালোচনা করে কর্তৃপক্ষ কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনার জন্য নিবন্ধন সনদ দিবে যার মেয়াদ ৩ বছর হবে এবং মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বেই নির্ধারিত ফি প্রদান করে নিবন্ধন নবায়ন করতে হবে বা প্রত্যাখ্যান করতে পারবে। (ধারা- ৪, ৫,৬)
কোন ব্যক্তি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনা করতে হলে তাকে নিম্নলিখিত শর্তপূরণ করতে হবে;
- বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে
- নির্ধারিত আর্থিক সচ্ছলতা থাকতে হবে
- দেউলিয়া হলে সেই দেউলিয়াত্বের অবসান ঘটাতে পারলে
- নৈতিক স্খলনজনিত কারণে দণ্ডিতে হলে দন্ডভোগের দুই বছর অতিবাহিত হয়ে থাকলে।
- নির্ধারিত শিক্ষাগত যোগ্যতা ও প্রশিক্ষণ থাকতে হবে
- নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত অবকাঠামো বা স্থাপনা থাকলে এবং
- বিধি দ্বারা নির্ধারিত অন্য কোনো শর্ত পূরণ করলে।
কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কেউ সনদ হস্তান্তর বা কেন্দ্রের অবস্থান বা ঠিকানা পরিবর্তন করতে পারবে না। নিবন্ধন সনদ ইস্যু হওয়ার ৬ মাসের মধ্যে কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনার কার্যক্রম শুরু করতে হবে। অন্যথায় সনদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হবে। (ধারা-৭)
এই আইনের ৯ ধারায় বলা হয়েছে, নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ যেকোন সময়ে তদন্ত ও শুনানী সাপেক্ষে কোন কেন্দ্রের নিবন্ধন স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে যদি-
- মিথ্যা তথ্য বা প্রতারনার মাধ্যমে সনদ গ্রহণ করলে,
- বিধি বা সনদের কোন শর্ত লঙ্ঘন করলে,
- নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিবন্ধন নবায়ন না করলে,
- নিবন্ধন গ্রহীতা কোন ফৌজদারী অপরাধে বা এই আইনের অধীনে কোন দন্ড পেয়ে থাকলে,
- কোম্পানি, সংস্থা, অংশীদারী প্রতিষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটলে,
- বিধি দ্বারা নির্ধারিত অন্য কোনো কারণে
নিবন্ধন বাতিল হলে আপিল করা যাবে
আইনের ১৮ ধারা অনুযায়ী, নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ যদি কোন কেন্দ্রের নিবন্ধন বাতিল বা স্থগিত করে তবে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ৩০ দিনের মধ্যে পূর্নবিবেচনার জন্যে আবেদন করতে পারবে। আবেদনের ৩০ দিনের মধ্যে নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ তা নিষ্পত্তি করবে।
১৯ ধারায় বলা হয়েছে, পূর্নবিবেচনার আদেশে সংক্ষুব্ধ হলে সরকার বরাবর আপিল করতে পারবে। সরকার পর্যালোচনা করে যে সিদ্ধান্ত দিবে সেটিই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।
মামলা দায়ের, তদন্ত ও বিচার
এই আইনের অধীনে সংঘটিত কোনো অপরাধের জন্য মামলা দায়ের, তদন্ত ও বিচার ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর বিধানাবলীতে হবে। ২৬ ধারা ব্যতীত অন্যান্য অপরাধগুলো অ-আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য ও আপোষযোগ্য। (ধারা-২৯)
এই আইনের অধীন সংঘটিত কোনো অপরাধ, মোবাইল কোর্ট আইন,২০০৯ অনুযায়ী, মোবাইল কোর্ট কর্তৃক বিচার্য হবে। (ধারা-৩০)
সাক্ষ্য গ্রহণ
অন্য কোনো আইনে যাই থাকুক না কেন, কেন্দ্রে সংঘটিত কোনো অপরাধের ভিডিও, স্থিরচিত্র বা আলোকচিত্র বা কোনো কথা-বার্তা বা আলাপ-আলোচনার রেকর্ড বা অন্য কোনো ডিজিটাল রেকর্ড অপরাধ সংশ্লিষ্ট হলে তা বিচারের সময় সাক্ষ্য হিসাবে আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে।
অপরাধ ও শাস্তি
- ‘শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র আইন, ২০২১’ এর ১০ ধারা অনুযায়ী, শিশু কেন্দ্র পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণে সেবা মূল্য নিতে পারবে তবে সেবা মূল্য দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শন করতে হবে।
- একই আইনের ১১ ধারায় বলা হয়েছে, কেন্দ্রে নিয়োজিত কর্মচারী কর্মকর্তাদের পরিচয়, আয়-ব্যয়ের হিসাব লিখিতভাবে বা ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতির সংরক্ষণ করতে হবে এবং বছর শেষে তা নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণ করতে হবে।
- ১২ ধারা অনুযায়ী, নির্ধারিত পদ্ধতি ও শর্ত মোতাবেক কেন্দ্র পরিচালনা করতে হবে। আইনগত অভিভাবক বা তাদের মনোনীত ব্যক্তির কাছ থেকে শিশু গ্রহণ এবং উক্ত অভিভাবক বা মনোনীত ব্যক্তির কাছে, নির্দিষ্ট সময়ে যাবতীয় তথ্যাদি সংরক্ষণ করে, শিশুকে হস্তান্তর করতে হবে। শিশু কেন্দ্রে শিশুর যাবতীয় সেবা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নিরাপত্তা, চিকিৎসা, বিনোদন, শিক্ষা, শিশুর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
- এই আইনের ১৪ ধারা অনুযায়ী, পরিদর্শক যেকোনো সময়ে যেকোনো কেন্দ্র প্রবেশ, লগ বুক, প্রতিবেদন, উপাত্ত, নথিপত্র, বিল বা অন্যবিধ দলিল পরীক্ষা ও চাইলে সম্পূর্ণ বা অংশ বিশেষের অনুলিপি বা ফটোকপি বা প্রয়োজনীয় তথ্যাদিও সংগ্রহ করতে পারবে এবং কেন্দ্র প্রতিষ্ঠাকারী, পরিচালনাকারী, নিয়ন্ত্রণকারী বা কেন্দ্রে কর্মরত কোনো কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে।
যদি কোন কেন্দ্র এই আইনের ১০, ১১, ১২, ১৪ ধারা অমান্য করে তবে তার বিরুদ্ধে নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ প্রশাসনিক জরিমানা আরোপ ও আদায় করতে পারবে। (ধারা-১৭)
আরো বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কোনো পরিদর্শকের নির্দেশ অমান্য করে বা কাজে বাধা প্রদান করে তবে পরিদর্শক তাকে অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা প্রশাসনিক জরিমানা করতে পারবে। (ধারা-২১)
- নিবন্ধন ছাড়া কোনো ব্যক্তি কোনো কেন্দ্র পরিচালনা করলে তবে তা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে এবং এর জন্যে অনধিক দুই বছরের কারাদন্ড বা অনধিক ১০ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড যা ৫ লক্ষ টাকার নিচে হবে না বা উভয়দন্ডে দণ্ডিত হবে। (ধারা-২০)
- যদি কোন ব্যক্তি সংক্রামক রোগ ছড়ায় বা বিস্তারে সহায়তা করে বা জানা সত্ত্বেও অভিভাবকদের সংক্রমণের ঝুঁকি সম্পর্কে অবগত না করে তবে উক্ত ব্যক্তির অনূর্ধ্ব ৬ মাসের কারাদন্ড বা এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দন্ডে দণ্ডিত হবে কিন্তু সংক্রমণ সম্পর্কে জানা সত্ত্বেও যদি ভূল বা মিথ্যা তথ্য দেয় তবে উক্ত ব্যক্তির অনূর্ধ্ব ৩ মাসের কারাদন্ড বা পঁচিশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দন্ডে দণ্ডিত হবে। (ধারা-২২)
- শিশু কেন্দ্রে শিশুর নিরাপত্তা বিপন্ন হয় এমন কোন কাজ করলে বা কর্মরত ব্যক্তি অবহেলার কারণে কেন্দ্রের কোন শিশুর স্বাস্থ্য ঝুঁকি বা স্বাস্থ্যহানি হলে, উক্ত ব্যক্তির অনূর্ধ্ব ২ বছরের কারাদন্ড বা দুই লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দন্ডে দণ্ডিত হবে। (ধারা-২৩ ও ২৪)
- এছাড়াও শিশুর প্রতি নিষ্ঠুর আচারন করলে অন্যূন ২ মাসের কারাদন্ড বা পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দন্ডে দণ্ডিত হবে। (ধারা-২৫)
- শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র হতে কোন শিশু নিখোঁজ বা হারিয়ে গেলে তা গুরতর অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। এর জন্য অনূর্ধ্ব দশ বছরের কারাদন্ড এবং পাঁচ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড দন্ডে দণ্ডিত হবে। (ধারা-২৬)
কোন কোম্পানির দ্বারা এই আইনের অধীনে কোন অপরাধ সংঘটিত হলে উক্ত অপরাধের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট পরিচালক, শেয়ার হোল্ডার বা ব্যবস্থাপনা ও সেবামূলক কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা, কর্মচারী উক্ত অপরাধ সংঘটন করেছেন বলে বিবেচিত হবে, যদি না তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, উক্ত অপরাধ তার অজ্ঞাতসারে সংঘটিত হয়েছে বা অপরাধ প্রতিরোধের জন্য যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। (ধারা-২৮)
লেখক: শিক্ষানবিশ আইনজীবী; জজ কোর্ট, ঢাকা