সাখাওয়াত সাজ্জাত সেজান
‘বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের অঙ্গিকার, সকল শিশুর সমান অধিকার,’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে এবারের শিশু দিবস ও বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন দেশব্যাপী পালন করা হয়েছে। কিন্তু সমান অধিকার শব্দ দুটো কেমন যেন অসমান হয়ে গেছে। কারণ শিশুরা বাংলাদেশে সমান অধিকারের আওতায় আসেনি। এদেশে এখনো প্রায় ১২ লাখ শিশু শিশু শ্রমে নিয়োজিত। শিশু শ্রম কমাতে বাংলাদেশে ‘আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা’ ১৯৯৪ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে। International Programme on the Elimination of Child Labour বাংলাদেশে অবিরত কাজ করে যাচ্ছিল শিশু শ্রম কমাতে। অবিশ্বাস্য হলেও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত শিশু শ্রম না কমে উল্টো বেড়েই চলেছে৷ প্রতিবেদনে প্রকাশিত ১২ লাখ শিশু ছাড়াও আর লাখ লাখ শিশু ”Informal Sector’ এ নিয়োজিত। আজ আপনি শহরের অলি গলিতে যে কোন রেস্তোরা আর হোটেলে গেলে শিশু শ্রমিক খুঁজে পাবেন।
চট্টগ্রামে শিল্পকলায় বসার সময় একটা ছেলে প্রায়ই চায়ের ফ্লাস্ক নিয়ে চা বিক্রি করতে আসে। এরকম শিশুদের খুঁজে পাইনি এমন কোন জায়গা মনে পড়েনা। আপনি যদি চোখ বন্ধ করে দেখেন তাহলে এমন একটিও জায়গা খুঁজে পাবেন না যেখানে শিশু শ্রমিক নেই। প্রতিবছর এখনো প্রায় ১৯ ভাগ শিশু প্রাথমিক শিক্ষা থেকে এবং ৩৭ শিশু মাধ্যমিক শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ে। এই ঝরে পড়া শিশুরা কেন ঝরে পড়ছে? কেন তারা প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিকের পর পড়াশুনা করতে পারছেনা! কেন তারা হোটেল রেস্তোরায়, জাহাজভাঙ্গা শিল্পে, হকার হয়ে কাজ করছে, কেন শিশুরা পথে প্রান্তরে!
বাংলাদেশে এখন অবধি ১৩ লাখ পথশিশু রয়েছে। তাদের ৭৫ ভাগই আবার ঢাকায় বসবাস করে। বাকি ২৫ ভাগ চট্টগ্রামসহ অন্যান্য জেলা শহরে বসবাস করছে৷ এই পথশিশুদের ৮৫ ভাগই মাদকাসক্ত। কাটাগায়ে নুনের ছিটে দেওয়ার মত করে, কোভিডের প্রকোপে পড়ে ২০২০ সালেই প্রায় ১৪০০০ বাল্যবিবাহ হয়েছে। এরা সবাই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থী। তাহলে এদের সমান অধিকার কিভাবে নিশ্চিত হবে! এই শিশুদের দায়চার কে নিবে! এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে সমান অধিকার নিশ্চিত না করে সমতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে৷ কারণ একজন উচ্চবিত্তের সন্তান, একজন মধ্যবিত্তের সন্তান এবং একজন নিন্মবিত্তের সন্তানকে সমান অধিকার কখনো এক নয়৷ সমতা কখনোই এই পিছিয়ে পড়া কিংবা ঝরে পড়া শিশুদের তাদের প্রয়োজনীয় অবস্থান ফিরিয়ে দিতে পারবেনা।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে শিশু আইন পাশ করেছিলেন। শিশু অধিকারকে অগ্রগামী রেখে এই আইন পাশ হয়েছিল। এই আইন পাশ করা হয় সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদকে বাস্তবায়ন করতে। এই অনুচ্ছেদ শিশুদের অধিকারকে সুনিশ্চিত করতে বিশেষায়িত ব্যবস্থা গ্রহণকে অনুপ্রাণিত করে। এই আইন পাশ হয় ‘শিশু অধিকার কনভেনশন ১৯৮৯’ আন্তর্জাতিকভাবে পাশ হওয়ার আগেই। এ থেকেই প্রমাণিত বঙ্গবন্ধু পৃথিবী থেকে এগিয়ে ছিলেন শিশু অধিকার সুনিশ্চিতকরণের বিষয়ে। বাংলাদেশ পুনরায় বিচারপতি ইম্মান আলীর নেতৃত্বে ২০১৩ সালে শিশু আইনকে সংশোধন করে ‘শিশু অধিকার কনভেনশন’ এর আলোকে বাস্তবায়ন করা হয়।
বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘শিশু হও, শিশুর মতো হও। শিশুর মতো হাসতে শেখো। দুনিয়ার ভালোবাসা পাবে।’ কিন্তু আমরা কেউই পথশিশু হতে চাইবনা। হোটেল রেস্তোরার মেসিয়ার হতে চাইবনা। চা-বিক্রেতা হতে চাইবনা। হকার হতে চাইবনা। শিশু হতে চাইলে আমরা সুন্দর আর সুনিশ্চিত শৈশব নিয়ে শিশু হতে চাইব। পড়াশুনা খেলাধূলা করা শৈশব চাইব। সমান অধিকারের বিপরীতে সাম্যের ভিত্তিতে আমরা শিশু অধিকার চাইব। যে শিশুর যতটুকু প্রয়োজন, সে প্রয়োজনটুকুই চাইব।
লেখক- প্রভাষক, আইন বিভাগ, ফেনী ইউনিভার্সিটি।