অ্যাডভোকেট আমেনা হুদা : শিরোনাম পড়ে বুঝতে পারেছেন আজকে আমি এমন একটি বিষয়ে লিখছি যা বর্তমান সময়ে অনেকাংশে বেড়ে গেছে। আপনাদের অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে কন্যাশিশু ধর্ষণ না লিখে শুধু শিশুধর্ষণ কেন লিখলাম? শিশু শব্দটি একটি উভয় বাচক শব্দ, যেটি দ্বারা কন্যা ও ছেলে শিশু দুটিকেই বুঝায়। এই ধরনের জঘন্য অপরাধের কারণ, শাস্তি, প্রতিকার এবং করণীয় সর্ম্পকে কিছু অভিজ্ঞতা সবার সাথে শেয়ার করবো আজ, যেগুলো আমার সর্বশেষ কর্মক্ষেত্রে করা দুটি মামলার অভিজ্ঞতা।
ঘটনা – ১
বর্তমান সময়ে আমরা পত্রিকা ও টিভি নিউজে দেখতে পাই ছেলে শিশুরাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছ এবং বেশিরভাগ ছেলে শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তাদের মাদ্রাসা শিক্ষক এবং তাদের খেলার সঙ্গীদের কাছ থেকে। এবার আসি মূল প্রসঙ্গে, আমি তখন বগুড়া ওসিসিতে কর্মরত, ঘটনার সূত্রপাত জুলাই ২০২০, হঠাৎ করে আমার অফিসের একজন অফিস সহায়ক আমাকে ফোন করে বললেন ম্যাডাম তাড়াতাড়ি অফিসে আসেন, একটি ৭ বছরের ছেলে শিশু ওসিসিতে ভর্তি হয়েছে ধর্ষণের শিকার হয়ে। তৎক্ষনাৎ জানালাম ভিকটিমের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন, বাকিটা আমি দেখছি।
ওসিসিতে গিয়ে ভিকটিমের মায়ের কাছে আমি ঘটনা জানতে চাইলাম, উনি আমাকে বললেন ভিকটিম দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে, করোনার কারণে এখন স্কুল বন্ধ তাই ভিকটিম তার বাড়ির পাশে কিছু সহপাঠীদের সাথে খেলা করছিল। হঠাৎ করে একটি ১৫-১৬ বছর বয়সী ছেলে তাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে বলে ওই এলাকায় পুকুর পাড়ে নিয়ে যায়, সময় ছিল আনুমানিক দুপুর ১টা, ভিকটিমের মুখ চেপে ধরে এবং তাকে জোড়পূবক ধর্ষণ করে, তাকে ভয় দেখায় যদি এই ঘটনা কারো কাছে বলে তাকে মেরে ফেলবে। অনেকটা সময় বাসায় না আসায় ভিকটিমের মা ভিকটিমকে খুঁজতে আসেন এবং খেলার মাঠে না পেয়ে বাড়িতে চলে যান।ঘটনার কিছু সময় পর ভিকটিম তার বাড়িতে আসেন এবং অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভিকটিমের মা জানতে চান ছেলের কাছে কোথায় ছিল এতক্ষণ। তখন ভিকটিম মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে ঘটনাটি জানায়।ভিকটিমের পরিবার সাথে সাথে স্থানীয় থানায় মামলা দায়ের করেন এবং পুলিশ আসামীকে গ্রেফতার করে।
ভিকটিমকে স্থানীয় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তার বগুড়া মেডিকেল কলেজে রেফার করে। যেহেতু ওসিসি এই সকল বিষয়ে সেবা প্রদান করে থাকে তাই ভিকটিম ওসিসিতে ভর্তি হয় এবং সকল দায়িত্ব পড়ে আমার অফিসের উপর।মামলা পরিচালনায় সহযোগিতা এবং ভিকটিমের প্রয়োজনীয় সকল সেবা প্রদান করা ছিল আমার দায়িত্ব। ভিকটিমের শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন দেখে আমি হাসপাতালের পরিচালক ও উপ-পরিচালক স্যারদেরকে জানাই ভিকটিমের স্পেশাল কেয়ারের প্রয়োজন। সাথে সাথে উনারা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং টানা ১৪ দিনের চিকিৎসা শেষে ভিকটিম সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যায়, ভিকটিমের প্রয়োজনীয় সকল সেবা প্রদান করে ওসিসি। কিন্তু আমার প্রশ্ন আমাদের সেবায় তাঁর শারীরিক আঘাত না হয় ভাল হয়েছে কিন্তু তার শিশু মনের আঘাত বা যে ভয় রয়ে গেছে তা কি করে দূর করবে তার পরিবার?
ঘটনা – ২
এবার আসি দ্বিতীয় ঘটনায়। বগুড়ার চাঞ্চল্যকর একটি মামলা যেটার সূত্রপাত ২০২০ সালের অক্টোবরের দিকে। অফিসে পত্রিকা পড়ার সময় চোখ আটকে যায় একটি নিউজে। ১৩ বছরের কন্যাশিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে ৫৫ বছরের এক হুজুর গ্রেফতার।এটি বগুড়া জেলার নন্দীগ্রাম উপজেলার ঘটনা। ঘটনার সপ্তাহখানেক পরে ভিকটিমকে নন্দীগ্রাম থেকে মেডিকেল কলেজে পাঠানো হয় ওসিসিতে রেফার করে। যথারীতি এটি আমাদের দায়িত্বের অংশ হিসেবে আমাদের তদারকিতে আসে।বগুড়া ওসিসির আইন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত থাকায় আমি ভিকটিমকে ওসিসিতে ভর্তি করে সম্পূর্ণ ঘটনা জানতে চাই।
ভিকটিম জানায়, আসামী তার আরবি শিক্ষক, সে তার অন্য সহপাঠীদের সাথে আসামীর বাড়িতে আরবি পড়তে যায়, ঘটনার দিন আসামীর স্ত্রী বাড়িতে ছিলেন না। ভিকটিম তার অন্য সহপাঠীসহ যথারীতি পড়াশোনা শেষ করে, আসামী বাকি সকলকে ছুটি দিয়ে ভিকটিমকে থাকতে বলে। হঠাৎ করে আসামী ভিকটিমকে মেরে ফেলার ভয় দেখায় এবং জোরপূর্বক তাকে ধর্ষণ করেন। ভিকটিমকে হুঁশিয়ারি করে যদি ঘটনা কাউকে প্রকাশ করে তাহলে তাকে মেরে ফেলা হবে।
ঘটনার প্রায় ২/৩ মাস পরে যখন ভিকটিমের শারীরিক অবস্থা অবনতির দিকে, ভিকটিমের মা খেয়াল করলেন তার মেয়েটি দিন দিন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে, একদিন ভিকটিমের অবস্থার অবনতি দেখে মা জানতে চান কি হয়েছে তোমার, তখন ভিকটিম মায়ের কাছে সম্পূর্ন ঘটনা খুলে বলে। ভিকটিমের মা স্থানীয়দের সহযোগিতায় নন্দীগ্রাম ওসিসিতে নিয়ে যায়, ভিকটিমকে ভর্তি করা হয় এবং থানায় মামলা দায়ের করা হয়। পুলিশ আসামীকে গ্রেফতার করে। ভিকটিমকে গাইনি ডাক্তার আল্টাসোনোগ্রাম করতে বলেন, পরে জানা যায় ভিকটিম ২/৩ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ঘটনার বর্ণনা শুনে আমিতো রীতিমতো দিশেহারা, ইতোমধ্যে এই ঘটনা সচিব, মন্ত্রী, জেলার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সরকারি, বেসরকারি এনজিও সকলের নজরদারিতে চলে আসে।
মন্ত্রনালয় থেকে নির্দেশনা আসল ভিকটিমকে সর্বপ্রকার সহযোগিতা প্রদানের।ভিকটিম ভর্তির পর থেকে এতো ফোন আসতে শুরু করল আমি প্রায় দিশেহারা। WNFPA থেকে সার্বিক বিষয় নজর রাখছিলেন এবং আপডেট নিতে থাকলেন আমার কাছ থেকে।পরিস্থিতি কঠিন হয়ে উঠল, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আমার সহযোগী মন্ত্রনালয় ছাড়া কারো সাথে কথা বলব না এই বিষয়ে, সকলকে জানাই আমার কোন ভিকটিমের তথ্য আমি দিতে বাধ্য নই। প্রয়োজন পড়লে আমরাই যোগাযোগ করব আপনাদের সাথে।
হাসপাতালের পরিচালক, উপ-পরিচালক স্যারদেরকে বিষয়টি জানাই কি করব এখন? কারণ এখানে শুধুমাত্র ভিকটিম নয় তার অনাগত সন্তানের কথাও চিন্তার বড় কারণ। বাংলাদেশ দন্ডবিধি ১৮৬০, ধারা ৩১২ -৩১৪ অনুযায়ী গর্ভপাত একটি দন্ডনীয় অপরাধ, তাই কোন গাইনী ডাক্তারকে চিকিৎসা দিতে বলতে পারছিলাম না কারণ যদি কোন প্রকার দূর্ঘটনা ঘটে তাহলে এটি একটি ডাবল মার্ডার কেইস হয়ে যাবে। কিন্তু এতে করে ভিকটিমের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে লাগলো।তখন আমরা সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম সর্বপ্রথম আমাদেরকে ভিকটিমকে বাঁচাতে হবে।
পরিচালক স্যার একটি মেডিকেল টিম তৈরি করে দেন এতে করে ভিকটিমের চিকিৎসা শুরু করা হয়, আস্তে আস্তে ভিকটিম কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠে। ভিকটিমের প্রয়োজনীয় সকল সেবা প্রদান শেষে ভিকটিম বাড়ি ফিরে যায়। ভিকটিম আমার নিয়মিত ফলোয়াপে ছিল, একদিন ভিকটিমের মা আমাকে জানান ভিকটিমের গর্ভপাত হয়ে গিয়েছে এবং ডাক্তার তাকে পুষ্টিযুক্ত খাবার দিতে বলেছেন কিন্তু তার কেনার সামর্থ্য নেই। তারপরের দিন WNFPA এর একটি মিটিংয়ে আমি গেস্ট হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। আমার সাথে যুক্ত ছিলেন ঢাকার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা, তখন আমি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করি এবং সকলকে জানাই তাদের আর্থিক সহায়তা ফান্ড আছে তারা যেন ভিকটিমকে সহায়তা করেন।
উপরোক্ত দুটি ঘটনা উদাহরণ মাত্র। এমন শতশত ঘটনার সাক্ষী প্রতিটি থানা ও ওসিসিগুলো কিন্তু এর শেষ কোথায়?
এই জঘন্য অপরাধের কারণ, শাস্তি, প্রতিকার এবং করণীয়
আইনের ভাষায় যদি ব্যাখ্যা করি, অপরাধ বিজ্ঞানের মতে একটি অপরাধ সংঘটনের পিছনে অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে, তার মধ্যে অন্যতম কারণগুলো হল -বিশ্বায়ন, সংস্কৃতিগত বৈষম্য, পারিবারিক ইতিহাস, রাজনৈতিক প্রভাব, অর্থনৈতিক অবস্থা, পরিবেশগত অপরাধ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার।
এবার আসি শিশুধর্ষণের মামলা কোন আইনের অধীনে এবং কত ধারায় দায়ের করতে হবে এবং শাস্তি কি হতে পারে? নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০০০ এর ৯(১) ধারায় বলা আছে – যদি কোন পুরুষ নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহলে তিনি মৃত্যুদন্ড বা যাবতজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দন্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হবেন। সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা সত্ত্বেও অপরাধ দমন করা কঠিন হয়ে পড়েছে কেন?
আমার ব্যক্তিগত কাজের অভিজ্ঞতা থেকে আমি মনে করি আইনের শাসনের পাশাপাশি সকলের ধর্মীয় শিক্ষার উপর জোর দেওয়া দরকার। পরিবারের সকল সদস্যের উচিত তাদের সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রতি জোর দেওয়া। উপরোক্ত বিষয়গুলোতে সবচাইতে বড় অবদান রাখতে পারেন মসজিদের ইমাম সাহেবগণ। উনারা যদি উনাদের জুমার খুতবায় একজন সত্যিকারের ভালো মানুষের মানবিক গুণাবলী এবং মানুষ হিসেবে দায়িত্ব ও কর্তব্য, নারীকে সম্মানের বিষয়ে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করেন, আমার মনে হয় উপরোক্ত অপরাধের প্রবনতা অনেকাংশে কমে যাবে।
এছাড়া, প্রতিটি পরিবারের উচিত তাদের সন্তানদের গতিবিধি খেয়াল রাখা, আপনার সন্তান কোথায় যায়? কাদের সাথে মেলামেশা করে এবং মোবাইলে সন্তান কি দেখে ইত্যাদি। প্রতিটি বাবা মায়ের উচিত তাদের সন্তানদের সাথে বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক বজায় রাখা। অনন্ত রাতের খাবার যেন সবাই মিলে এক সাথে খাওয়া, যাতে করে সন্তানরা তাদের মতামত শেয়ার করতে পারেন বাবা-মার সাথে। কারণ পরিবার হল সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
পরিশেষে বলতে চাই, আপনার সন্তানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার পাশাপাশি তাকে মানবিক হতে সহায়তাকরুন। আমি আশাবাদী এই সমাজে একদিন পরিবর্তন আসবেই, প্রয়োজন শুধুমাত্র সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার।
লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এবং সাবেক আইন কর্মকর্তা, ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়।