ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ:
‘পাকিস্তান’ডিমনেসিয়ায়’ ভুগছে। ‘ডিমনেসিয়া’ একটি অসুখ। এর অর্থ হলো ‘স্মৃতিভ্রম’। পাকিস্তানে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন না হওয়ার জন্য পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খাজা আসিফ সম্প্রতি বাংলাদেশকে দুষলেন। অথচ ২০১৬ সালে যখন সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলোনা তখন কিন্তু তারা দোষ দিয়েছিলেন ভারতের। সেটা কিন্তু একদম কাগজে- কলমে-রেকর্ডে- বিবৃতিতে রয়েছে। তখন তারা ভারতকে দোষ দিল। আজকে তারা হঠাৎ করে বাংলাদেশকে দোষ দিচ্ছে। এটা কী হাস্যকর ও অযৌক্তিক নয়? সার্কভুক্ত আটটি রাষ্ট্রের মধ্যে নেপাল সার্কের সভাপতি। বাংলাদেশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেনা, এমন কথা জানানোর আগেই কিন্তু ভারত, ভুটান, আফগানিস্তান সম্মেলন বর্জনের ঘোষনা দেয়। ৩০ সেপ্টেম্বর সম্মেলন প্রত্যাখ্যান করে শ্রীলংকা। মালদ্বীপ তারও পরে ১ অক্টোবর সম্মেলনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানায়।
এখন আসা যাক, কেন তারা সম্মেলন বর্জন করেছিল। ভারত বলছে, পাকিস্তানের সাথে তাদের ‘কাশ্মীর’ ইস্যু নিয়ে সমস্যা আছে। অন্য রাষ্ট্রগুলো বলল, পাকিস্তান একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। তারা সন্ত্রাসীদের মদদ দেয়। তাদের ওখানে সার্ক সম্মেলনে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু বাংলাদেশ বলছে এখানে দু’টি ইস্যু। এক. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সংক্রান্ত ব্যাপারে পাকিস্তান তাদের অভ্যন্তরীর বিষয়ে নাক গলিয়েছে। দুই. পাকিস্তান একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র।কিন্তু এসব অভিযোগকে এড়িয়ে গিয়ে তারা যখন বলে, বাংলাদেশের কারণে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন হয়নি, তখন বুঝতে বাকি থাকেনা যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রটির স্মৃতিভ্রম ঘটেছে। আসলেই পাকিস্থান একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় তারা বলল, তারা এ বিচার সমর্থন করেনা। তারা এ ব্যপারে অসন্তোষ। তার মানে তারা গণহত্যাকে সমর্থন করে। কারণ তারা নিজেরাই একটি গণহত্যাকারী রাষ্ট্র।
পাকিস্তান বলছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের ত্রি-পক্ষীয় চুক্তি ভঙ্গ হয়েছে। পাকিস্তানের এ কথাও প্রমাণ করে তারা ডিমনেসিয়ার রোগী। কারণ, ১৯৭৪ সালের ত্রি-পক্ষীয় চুক্তি কোনভাবেই আমাদের উপর বাধ্যতামূলক নয়। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ- এ ধরনের কোন অপরাধ কোনভাবেই ক্ষমাযোগ্য নয়। এসব অপরাধে কেউ কাউকে ক্ষমা করতে পারেনা। এসব অপরাধে কেউ যদি কাউকে মাফ করে তাহলে ভিয়েনা কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ১৫৩ অনুযায়ী চুক্তিটি বাতিল হয়ে যায়। এই চুক্তি অনুযায়ী ত্রি পক্ষীয় চুক্তিটি একটি বাতিল চুক্তি। এই চুক্তির কোন কার্যকারীতা আন্তর্জাতিক আইনেও নেই, আমাদের দেশীয় আইনেও নেই। তার প্রমাণ হচ্ছে, আমার দেশের আইনে কোন আন্তর্জাতিক চুক্তি তখনই বাধ্যতামূলক হবে যখন সেটি সংবিধানের ১৪৫(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আমার দেশের সংসদে সেটি পাস হবে। কিন্তু কখনো এই চুক্তি আমাদের সংসদে উথাপিত হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বলছি পাকিস্থানের স্মৃতিভ্রম ঘটেছে? কারণ হচ্ছে, তারা বলছে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী সহ আজকে আমাদের এখানে যাদের বিচার হচ্ছে তাদের বিচার আমরা করব না, এমন একটি ওয়াদা নাকি আমরা করেছিলাম। পাকিস্তানের স্মৃতির এমন দেউলিয়াত্ব হয়ে গেছে যে, বাংলাদেশের আল বদর, আল শামস রাজাকার নিয়ে একটা লাইনও ত্রি-পক্ষীয় চুক্তিতে নেই। যদি তারা মনে করে ঐ চুক্তির দোহাই দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারের সমালোচনা তারা করবে, তাহলে তাদের বক্তব্য অনুযায়ী রাজাকার আল-বদর, আল-শামসরা তাদের দেশের নাগরিক। মানে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী। তাহলে তাদের বিচার কী তোমরা চাওনা? এখন এটিতো শুধু বাংলাদেশ পাকিস্তানের ইস্যু না। বরং এটি পুরো মানব সভ্যতার একটি বিষয়। যে কোন সভ্য রাষ্ট্র অপরাধীর বিচার চাইবে, সেটাই স্বাভাবিক।
আমি মনে করি পাকিস্তানের ব্যাপারে বাংলাদেশের এখনই কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ। পাকিস্তান একটি অসভ্য রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তারা কোন আইন মানছে না। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বা সম্প্রীতির প্রতি তাদের কোন শ্রদ্ধা নেই। শুধু বাংলাদেশ নয়, সার্কের সকল সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রের উচিত পাকিস্তানের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করা। সার্কের লক্ষ্য ও উদ্দ্যেশ্যে বলা আছে, ” বন্ধুত্ব, আস্থা ও পারষ্পরিক সমঝোতা হবে সার্কভুক্ত দেশগুলোর সম্পর্কের ভিত্তি। সার্কের আওতাভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের কোন বন্ধু নেই। থাকলে আমরা তা দেখতাম। বাংলাদেশ না হয় অংশগ্রহণ করেনি। অন্যরা তো করতে পারত। কিন্তু অন্য কোন সদস্য রাষ্ট্রও অংশগ্রহণ করেনি। পাকিস্তানের প্রতি আমাদের কারো কোন আস্থা নেই। পাকিস্তান একটা সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। কেউ কাউকে মানছে না। কোন আইনের প্রয়োগ নেই। যেখানে সেখানে বোমাবাজি হচ্ছে। স্কুল উড়ে যাচ্ছে, নামায পড়া অবস্থায় মসজিদ উড়ে যাচ্ছে। আর পারষ্পরিক সমঝোতার ব্যপারে পাকিস্থান কখনো কোন ক্ষেত্রে এগিয়ে আসেনি। ৭১-এ এরকম ভয়াবহ গণহত্যা করার পরেও তাদের মধ্যে কোনপ্রকার অনুশোচনা জাগেনি। বরং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে তারা অসন্তোষ প্রকাশ করল। ‘শান্তি’ ও ‘নিরাপত্তা’ সার্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু শান্তির জন্য সার্ক জোনে পাকিস্তানকে কখনোই পাওয়া যায়না। শান্তি বিঘ্ন ঘটায় পাকিস্থান। আবার নিরাপত্তার জন্য হুমকিও তারা। পাকিস্তানের চার্টার অনুযায়ী পাকিস্তানের সার্কভুক্ত থাকার কোন অধিকার নেই।
লেখক: প্রসিকিউটর, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং অধ্যাপক , আইন বিভাগ , ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি