সিরাজ প্রামাণিক : অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট-১৯২৩ আইনটি একটি ঔপনিবেশিক আইন। বৃটিশরা ভারত শাসনের সময় তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে এই আইনটি এ দেশের জনগনের উপর চাপিয়ে দেয়। এটি এমন একটি আইন যেখানে সরকারি বা দাপ্তরিক গোপনীয়তা সংক্রান্ত আইন একত্রীভূত করা হয়েছে। এতে গুপ্তচরবৃত্তি ও গোপন তথ্য আদান প্রদানের মতো অপরাধের বিচার ও দন্ড সম্পর্কে বিধান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এই আইনের ৩ নম্বর ধারায় কিছু কিছু কাজকে শাস্তিমূলক অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো এই যে, আইনের জুজুর ভয় দেখিয়ে মফস্বলের এমনকি গ্রামের তহশিল অফিসের নিম্ন পদস্থ কর্মচারীরাও জনগণকে কোনো প্রকার তথ্য দিতে গড়িমসি করে। ৩ নম্বর ধারায় গুপ্তচর বৃত্তির জন্য দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এই ধারার অধীনে কেউ অপরাধ করলে ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এই আইনের ৫ ধারায় তথ্যের আদান প্রদান সংক্রান্ত বিধান রয়েছে।
অফিসিয়াল সিক্রেটস আ্যাক্ট, ১৯২৩- এর ৩ ও ৫ ধারা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নিষিদ্ধ স্থানের দোহাই দিয়ে সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শুরুতে অধিকার আইন নিয়ে যখন অনেক তোড়জোড় চলছিল, তখন অনেকেই মতামত দিয়েছিলেন উপরোক্ত ধারাটি সংশোধন ছাড়া অধিকার আইনের প্রকৃত বাস্তবায়ন হওয়া সম্ভব না। শেষমেশ তথ্য অধিকার আইন কার্যকর হয়েছে।
এতে স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, পূর্বতন সব আইনের উপর নতুন আইনটির প্রাধান্যের কথা। এমনকি অফিসিয়াল সিক্রেটস আ্যাক্ট বা সরকারি গোপনীয়তা আইনও এ ক্ষেত্রে কোনো বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না।
তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯: ধারা-৩ এ বলা হয়েছে যে, প্রচলিত অন্য কোনো আইনের ক. তথ্য প্রদান সংক্রান্ত বিধানাবলি এই আইনের বিধানবলী দ্বারা ক্ষুন্ন হইবে না, এবং তথ্য প্রদান বাধা সংক্রান্ত বিধানাবলী এই আইনের বিধানাবলীর সহিত সাংঘর্ষিক হইলে, এই আইনের বিধাবলী প্রাধান্য পাইবে।
এগুলো আশার কথা সন্দেহ নেই। তবুও এই ধারার ফাঁক গলে সরকারি কর্তা ব্যক্তিরা যেন কখনই তথ্য দেয়ার ক্ষেত্রে গোপনীয়তা আইনকে সামনে না নিয়ে আসতে পারেন সেক্ষেত্রে সজাগ ও সচেতন থাকা প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রে সাংবাদিকদেরই হতে হবে আরও সচেতন ও প্রশিক্ষিত। কেননা এই আইনের জায়গায় আরেক আইনের অজুহাত তুলে কর্তা ব্যক্তিদের বিপত্তি সৃষ্টি করার ভুরি ভুরি নজির আছে।
‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে’র দোহায় দিয়ে ১৮ মে’ ২০২১ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়। ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের’ ৩ ও ৫ ধারায় গুপ্তচরবৃত্তি ও রাষ্ট্রীয় গোপন নথি নিজের দখলে রাখার অভিযোগ এনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ মামলা করে রোজিনাকে জেল হাজতে পাঠান।
সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রেস কাউন্সিলে মামলায় প্রবনতার চাইতে ফৌজদারী আইনে মামলা দায়েরে প্রবনতা সংবাদ কর্মীদের আতংকিত রাখে। বিশেষ করে কোন সংবাদে সরকার ক্ষুব্ধ হলে প্রেস কাউন্সিলে না গিয়ে অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট ও বিশেষ ক্ষমতা আইন সহ তাদের হাতে থাকা কঠিন অস্ত্র সমুহ ব্যবহার করে। এটা মুক্ত বুদ্ধি চর্চা ও স্বাধীন সংবাদ পত্রের নীতিমালা বিরোধী।
জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষনার ১৯ ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে “প্রত্যেকেরই বাক স্বাধীনতা এবং চিন্তার স্বাধীনতা থাকতে হবে। প্রত্যেকের নিজস্ব মত পোষণে কোন বাধা থাকবে না। এবং যে কোন সংবাদ গ্রহন ও বিতরণ করার বিধি নিষেধহীন অধিকার থাকবে।”
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হলেও অসংখ্য কালা কানুনের শৃংখলে আবদ্ধ সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্র।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সাংবিধানিক অধিকার, সংবিধান কার্যকর অবস্থায় নিরাপত্তা আইনে খর্ব করা অবৈধ, এই মর্মে পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের একটি সিদ্ধান্ত ও আলোচনা দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই।
করাচীর মাসিক মিরর পত্রিকার বিরুদ্ধে ১৯৫৭ সালের ৯ই নভেম্বর একটি নির্দেশ প্রদান করা হয়। ঐ নির্দেশে সরকার ১৯৫২ সালের পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনের ১২(১) ধারা মোতাবেক ৬ মাসের জন্য ‘মিরর’ পত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক মিসেস জেবুন নেছা হামিদুল্লাহ একটি রীট মামলা দায়ের করে সরকারি নিষেধাজ্ঞা আদেশ চ্যালেঞ্জ করেন। সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি মোহম্মদ মুনির রায়ে রায়ে উল্লেখ করেনঃ
‘পাকিস্তানের নিরাপত্তা আইন ১৯৫২ সালে জারী করা হয় এবং এটি প্রাক সাংবিধানিক আইন। যে সময় মৌলিক অধিকার নিশ্চয়তা প্রদানকারী সংবিধানের অস্তিত্ব ছিল না। এবং সরকারের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ছিল বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার, নিজের সুবিধা ও উদ্দেশ্য পূরণের জন্য আইন জারী করার। সংবিধান জারীর পর এই ক্ষমতার অস্তিত্ব নাই এবং সরকার সংবিধানের ৮নং অনুচ্ছেদে উল্লেখিত উদ্দেশ্য ব্যতীত বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করতে পারে না।’
পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনের ১২ ধারা যে কোনো কারণে সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ করার অনুমতি সরকারকে প্রদান করেছিল, যা সংবিধান চালু হবার পর অকার্যকর হয়েছে। (১০ ডিএল আর (এসসি) ৪৪ মিসেস জেবুন নেছা হামিদুল্লাহ বনাম পাকিস্তান সরকার।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। ই-মেইল: seraj.pramanik@gmail.com