মো. সালাউদ্দিন সাইমুম : রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের পরে কল্লোল যুগের যেসব লেখক সাহিত্যজগতে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেন, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি একাধারে ছিলেন একজন কবি, ঔপন্যাসিক ও সম্পাদক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের এই তুখোড় ছাত্রটির বিচারিক কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৩১ সালে। ছিলেন জেলা জজ কিন্তু সাহিত্যের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ থেকে অসংখ্য অসামান্য লেখনী আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন।
‘কোর্ট-কাচারি’ অচিন্ত্যকুমারের অনন্যসাধারণ এক লেখনী। মাত্র ১২২ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থটিতে কি নেই! একজন পাঠক ঠিক যতটা পাঠরস একটি বই থেকে আকাঙ্খা করতে পারে তার সবটুকুনই এখানে খুঁজে পাবে। কোর্ট-কাচারি, আদালতের সাহিত্য, তদবির, আপোস, দুই উকিল, কালো কোট- এর মতো লেখা প্রতিটি পাঠককে মোহিত করবে; হোক সে আইন পড়ুয়া কিংবা উৎসাহী অর্বাচীন পাঠক।
বইটির প্রথম লেখনী মাত্র পাঁচ পৃষ্ঠার এক অসাধারণ ছোটগল্প ‘কোর্ট-কাচারি’। এটাকে শুধুই গল্প বলা যায় না বৈকি; আইন-আবেগ-দর্শন-সাহিত্যসুধা সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে যেন এক মোহনায় মিলে গেছে! যারা সাহিত্যে আইনের সুধান্বেষণে ব্যতিব্যস্ত তাদের নিকট নিঃসন্দেহে এই গল্পখানি অমৃতসম ঠেকবে।
গল্পের শুরুতেই আদালতের যে চিত্র একেছেন লেখক, তার সত্যিই জুড়ি মেলা ভার! লেখকের ভাষায়-
পূর্ণিমার তুল্য রাত নেই, তেমনি বটের তুল্য বৃক্ষ নেই। আর হাটের যেমন আটচালা, কোর্টের তেমনি বটতলা। এই বটতলায় সাক্ষীরা বসে, মক্কেলরা ঘোরাফেরা করে আর ওইখানেই দালালদের দা-এর কোপ…..!
লেখক আদালতকে তীর্থস্থানের মহিমা দিয়েছেন। তার নমুনা দেখুন-
কত তীর্থ ঘুরেছি, এ এক অদ্ভুত তীর্থ-বটতলা। সম্ভ্রান্ত করে বললে, কোর্ট-কাচারি।
উকিল যে আদালতের প্রাণভোমরা অকাট্যচিত্তে লেখক তা ব্যক্ত করেছেন-
মেঘের শোভা যেমন সৌদামিনী, তেমনি আদালতের শোভা উকিল-মোক্তার।
কোর্ট-কাচারি লিখনীটিতে লেখক সাহিত্যঢঙে এমন কতিপয় আপ্তবাক্য তুলে ধরেছেন যা বহুদিন পাঠকহৃদয়ে দাগ কেটে থাকার মতো। এমনই একটি আপ্তবাক্য-
বৈষ্ণব চিনি কপনিতে, মোল্লা চিনি দাড়িতে, তেমনি উকিল চিনি আলপাকায়।
তবে পুরো গল্পে আমার যে মন্ত্রবাক্যটি সবথেকে বেশি মনে ধরেছে সেটি পাঠক পড়ামাত্রই হতচকিত হয়ে যাবে বৈকি। সেটি নিম্নরূপ-
মুখেন মারিতং জগৎ
একটু বিশদ করলে মনে হয় পাঠক সুবিধা নিশ্চিত হয়। লেখকের ভাষায়-
কোর্টে-কোর্টে ঘুরি আর শুনি কাকে বলে জেরা, কাকে বলে সওয়াল-জবাব। কাকে বলে মুখেন মারিতং জগৎ!
হ্যাঁ, ঠিক তাই একজন তুখোড় আইনজীবীর মুখ চলতেই হবে। বাক্যবানে প্রতিপক্ষকে বধ করতে হবে।
তবে আইনজীবীকে বাক্য প্রয়োগে সংযতও থাকতে হবে বৈকি। ক্ষুরধার বাক্যের ক্ষুর যেন শরীরী আচরণে প্রকাশ না পায়, মুখেতেই তা যেন সীমাবদ্ধ থাকে। লেখকের ভাষ্যে-
মুখকে ক্ষুরের ধার করা নয়, হৃদয়ে ক্ষুর থাক, মুখে মধু। কথার নামও মধুবাণী যদি কথা কইতে জানি।
গল্পে নবীন আইনজীবীদের প্রতিও উপদেশ লুকিয়ে আছে এমনভাবে-
দেবতা বুঝে ভজন করো
আইনকে শুধু নয় হাকিমকেও জানো।
আইনের বটতলায় বিচরণ করতে করতেই একদিন আমাদের আইনের মানুষগুলোই সাধারণ থেকে অনন্যসাধারণ হয়ে ওঠে। ঠিক লেখক যেমনটা হয়েছিলেন। সাহিত্যে আইনের রস খুঁজতে গিয়ে একদিন যেমন শঙ্করের ‘কত অজানারে’ পড়তে হয়, ঠিক তেমনি আইনকে দ্রাক্ষারসের মতো আস্বাদন করতে চাইলে অচিন্ত্যকুমারের এই গল্পখানি এক অতুলনীয় পূর্বপাঠ হতে বাধ্য।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।