দেশের সকল বিচারিক (অধস্তন) আদালত ও ট্রাইব্যুনালসমূহকে কোন মামলায় আসামিকে সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে রায় ঘোষণার আগে অভিযুক্তের শাস্তির বিষয়ে পৃথক শুনানি করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
মো. লাভলু ওরফে লাভলু বনাম রাষ্ট্র মামলায় ডেথ রেফারেন্স, ফৌজদারি আপিল ও জেল আপিলের শুনানি শেষে বিচারপতি হাসান আরিফ ও বিচারপতি বিশ্বজিৎ দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন।
রায়ে হাইকোর্ট ডেথ রেফারেন্স খারিজ করেন এবং এ মামলায় বিচারিক আদালতে আসামিকে দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বাতিল করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন। সেই সাথে আসামী কারাগারে থাকা সময়ের জন্য দোষী সাজাপ্রাপ্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৩৫(এ) এর সুবিধা পাবেন৷ আসামিকে অতিসত্বর কনডেম সেল (মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের জন্য বরাদ্দ বিশেষ কক্ষ) থেকে সাধারণ কারাগারে স্থানান্তর করতে বলা হয়েছে।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ঘোষিত এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। এতে রায় ঘোষণার আগে অভিযুক্তের শাস্তির বিষয়ে পৃথক শুনানির ক্ষেত্রে বিচারিক আদালত ও ট্রাইব্যুনালসমূহকে ৩ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত।
তিন দফা নির্দেশনা নিম্নরূপ-
(ক) মামলার পক্ষদ্বয়ের যুক্তিতর্কের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারক যখন অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা যেকোন মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করার সিদ্ধান্ত নেন তখন উন্মুক্ত আদালতে পক্ষদ্বয়ের কাছে তা ব্যক্ত করবেন। পাশাপাশি অভিযুক্তের সাজা নির্ধারণের জন্য পৃথক শুনানির জন্য সংক্ষিপ্ততম সময়ের মধ্যে একটি তারিখ নির্ধারণ করবেন।
(খ) এই ধরনের শুনানিতে, অভিযুক্তের সামাজিক পটভূমি, অপরাধের রেকর্ড, বয়স, আর্থিক অবস্থা ইত্যাদি সহ আসামির সাজা হ্রাস-বৃদ্ধির বিষয়ে (the aggravating and mitigating materials) পক্ষগুলোর বক্তব্য উত্থাপনের সুযোগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ধারা ৩৬৭ এর উপ-ধারা (৫) এ অন্তর্নিহিত আইনসভার অভিপ্রায় এবং যেমনটা আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে [Ataur Mridha vs. State, 73 DLR (AD) (2021)-298] নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা মাথায় রাখতে হবে।
গ) এই ধরনের শুনানিতে, বিচারক আসামির সাজা হ্রাস-বৃদ্ধির উভয় ক্ষেত্রে (aggravating and mitigating circumstances) ভারসাম্য বজায় রেখে সাজার প্রকৃতি, অপরাধীর বয়স এবং চরিত্র, ব্যক্তি বা সমাজের প্রতি আঘাত, অভিযুক্ত নৈমিত্তিক বা পেশাদার অপরাধী, অপরাধীর উপর শাস্তির প্রভাব, বিচারে বিলম্ব এবং দীর্ঘস্থায়ী বিচার চলাকালীন অপরাধীর মানসিক যন্ত্রণা এবং এমনকি অপরাধীর সংশোধন ও সংস্কার ইত্যাদি দিকে বিশেষভাবে নজর রাখবেন। এসব কিছু বিশ্লেষণ করে বিচারক বিচার করবেন এবং সাজাসহ দোষী সাব্যস্ত হওয়ার রায় ও আদেশ ঘোষণা করবেন।
উপরোক্ত নির্দেশাবলী সম্বলিত রায়ের একটি অনুলিপি দেশের সকল বিচারিক (অধস্তন) আদালত ও ট্রাইব্যুনালে প্রেরণ অথবা এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে একটি সার্কুলার জারি করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।
আদালতের পর্যবেক্ষণ
রায়ে আদালত বলেন, উপমহাদেশে সাজা প্রদান করা এখন অনেক আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ উপযুক্ত ও আনুপাতিক সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিচারক কর্তৃক কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার অনুপস্থিতি নিয়ে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আতাউর মৃধা বনাম রাষ্ট্র মামলায় [Ataur Mridha vs. State, 73 DLR (AD) (2021)-298] হতাশা প্রকাশ করেছে৷
আদালত আরো বলেন, এটা ঠিক যে দেশের প্রচলিত আইনে, বিশেষ করে ফৌজদারি কার্যবিধিতে, পৃথক সাজা শুনানির জন্য কোন সুনির্দিষ্ট বিধান নেই। তবে, এই ধরনের শুনানি অনুষ্ঠিত হতে কোন বাধা নেই। তবে দোষী সাব্যস্ত হওয়া এবং সাজা শুনানির বিষয়ে পৃথকভাবে শুনানির পক্ষে আইনসভার অভিপ্রায় রয়েছে।
ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ধারা ৩৬৭ এর উপ-ধারা (৫) এ উল্লেখ করা হয়েছে, যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা যেকোন মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার জন্য দোষী সাব্যস্ত হয় তবে আদালত তার রায়ে এই শাস্তির কারণ উল্লেখ করতে হবে।
একজন ব্যক্তির জীবন কেড়ে নেওয়া একটি অত্যন্ত গুরুতর কাজ এবং আইনগত আদালত সর্বদা এ জাতীয় কোনও আদেশ দিতে নারাজ যদি না এটি আইনসভার আইন দ্বারা তা করতে বাধ্য হয়। আধুনিক বিশ্বের কিছু দেশ ইতিমধ্যেই মৃত্যুদণ্ড বাতিল করেছে বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয়।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ
যশোর সদর উপজেলার এড়েন্দা গ্রামে আট বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যার দায়ে লাভলুকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। একইসঙ্গে তাকে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।
২০১৭ সালের ৩০ মে যশোর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক অমিত কুমার দে এ রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণা শেষে দণ্ডিত লাভলুকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন বিচারক।
লাভলু যশোর সদরের এড়েন্দা গ্রামের ইন্তাজ আলীর ছেলে। এ মামলার অপর আসামি আনোয়ার বিচার শুরুর আগেই মারা যাওয়ায় তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২৩ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে সাবিনাকে তার প্রতিবেশী লাভলু ও আনোয়ার মিষ্টি খাওয়ানোর কথা বলে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায়। এরপর তারা শিশুটিকে বাড়ির পাশে একটি পটল ক্ষেতে নিয়ে ধর্ষণ ও শ্বাসরোধে হত্যা করে।
এরপর একটি ধান ক্ষেতের মধ্যে লাশ ফেলে চলে যায়। সাবিনার খোঁজ না পেয়ে তার পরিবারের লোকজনসহ এলাকাবাসী খোঁজ-খবর শুরু করে। রাতে ধানক্ষেত থেকে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
সাবিনার বাবা বিল্লাল হোসেন ঘটনার পরদিন লাভলু ও আনোয়ারকে আসামি করে মামলা করেন। দীর্ঘ শুনানি শেষে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিচারক আসামি লাভলুকে মৃত্যুদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা আদায়ের নির্দেশ দেন।
পরবর্তীতে মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য ডেথ রেফারেন্স এবং আসামির ফৌজদারি আপিল ও জেল আপিল শুনানির জন্য মামলাটি হাইকোর্টে আসে। উচ্চ আদালত শুনানি শেষে বিচারিক আদালতে আসামিকে দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বাতিল করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে উপরোক্ত রায় দেন।