মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী : কক্সবাজারের সদ্য বিদায়ী সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল-কে হাইকোর্টের একটি রিভিশন মামলায় আগামী ১৬ আগস্ট ব্যাখ্যা দিতে তলব করা আদেশটি প্রত্যাহার (Recalled) করা হয়েছে।
হাইকোর্টের বিচারপতি মো. বদরুজ্জামান ও বিচারপতি এস.এম মাসুদ হোসেন দোলনের বেঞ্চ ২১৮৪/২০২৩ নম্বর রিভিশন মামলায় রোববার (১৩ আগস্ট) এ আদেশ দেন।
সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আদেশে বলা হয়েছে, হাইকোর্টের উক্ত আদেশের আগেই সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগে হাইকোর্টের প্রদত্ত রুল চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি (ডিসচার্জ) করার বিষয়টি হাইকোর্ট বেঞ্চ অবহিত ছিলেন না। পরে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ জানতে পেরেছেন, হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগে আসামীদের পক্ষে ফৌজদারী আপীল দায়ের করা হয়। যার নম্বর : ১৬৬১/২০২৩ ইংরেজি।
ফৌজদারী আপীলটি গত ২৪ জুলাই প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী’র নেতৃত্বে গঠিত ৪ সদস্যের আপীল বিভাগ গত ২৪ জুলাই ১৬৬১/২০২৩ নম্বর ফৌজদারী আপীলটির দীর্ঘ শুনানী শেষে হাইকোর্টের ২১৮৪/২০২৩ নম্বর রিভিশন মামলাটির রুল খারিজ (ডিসচার্জ) করে চূড়ান্তভাবে আদেশ প্রদান করেছেন।
তাই হাইকোর্টের আদেশটি প্রত্যাহার (recalled) করা হয়েছে এবং প্রত্যাহারের বিষয়টি দ্রুত কক্সবাজারের সদ্য বিদায়ী সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল-কে অবহিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
হাইকোর্টে রোববার (১৩ আগস্ট) প্রদত্ত আদেশে উল্লেখ করা হয়-
The result of said criminal Leave petition was not inform to this court. But in the meantime, on 08.08.2023 this Court passed an order directing the learned session judge, Cox’s Bazar to appear in-person, on the 18.08.2023.
Since the rule has discharge by the Appellate Division, the order dated 08.08.2023 is recalled.
Communicate at Once.
The office is directed to take note that Rule has discharge vide order of the Appellate Division.
কক্সবাজার আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫ ফেব্রুয়ারী টেকনাফের সেন্টমার্টিনে জমির বিরোধ নিয়ে সংগঠিত এক ঘটনায় বিরোধীয় জমির কেয়ারটেকার ও সেন্টমার্টিনের সাবেক মেম্বার শামসুল ইসলাম বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় ১০ জনকে আসামী করে একটি মামলা দায়ের করেন। যার টেকনাফ থানা মামলা নম্বর : ৪৫, তারিখ : ২৬/০২/২০২৩ ইংরেজি, যার জিআর মামলা নম্বর : ১১৭/২০২৩ ইংরেজি (টেকনাফ)।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের জেলা নাজির বেদারুল আলম জানান, উক্ত মামলার ১ ও ২ নম্বর আসামি যথাক্রমে মৃত মৌলভী এজাহার মিয়ার পুত্র মোঃ আবদুর রহমান ও জামাল হোসাইনের পুত্র মৌলভী রফিক আহমদ গত ৬ মার্চ হাইকোর্ট থেকে ৬ সপ্তাহের আগাম জামিন নেন। ৬ সপ্তাহের আগাম জামিনের মেয়াদ শেষে হাইকোর্টের আদেশ মতে তারা ১৬ এপ্রিল কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের আদালতে আত্মসমর্পণ করে পূণরায় জামিনের আবেদন করেন। ওই সময় জেলা ও দায়রা জজ তাদের জামিন আবেদনটি শুনানির জন্য ২৫ এপ্রিল পরবর্তী দিন ধার্য করেন।
নির্ধারিত তারিখে জামিন আবেদনটি শুনানী শেষে মামলার গুণাগুণ বিবেচনায় সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল আসামিদের জামিন মঞ্জুর করেন। এসময় আদালতে অন্যান্যদের সাথে বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট কফিল উদ্দিন চৌধুরী ও রাষ্ট্র পক্ষে পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম ফরিদ শুনানীতে যথারীতি অংশ নেন বলে জানান, কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের জেলা নাজির বেদারুল আলম।
পরে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রদত্ত জামিন আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে আসামীদ্বয়ের জামিন বাতিলের আবেদন জানিয়ে বিরোধপূর্ণ জমির মালিক ও টেকনাফ থানার ১১৭/২০২৩ নম্বর জিআর মামলার সাক্ষী অ্যাডভোকেট নূরুল আমিন বাদী হয়ে গত ৪ জুন হাইকোর্টে একটি রিভিশন মামলা দায়ের করেন। যার নম্বর : ২১৮৪/২০২৩ ইংরেজি।
ওই রিভিশন মামলাটি শুনানি শেষে গত ৭ জুন উল্লেখিত দুই জন আসামির জামিন বাতিল করে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজের কাছে ব্যাখ্যা তলব করেন বিচারপতি মো. বদরুজ্জামান ও বিচারপতি এস. এম মাসুদ হোসেন দোলনের বেঞ্চ।
পরে ৯ জুলাই ব্যাখ্যা দেন, কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল। ব্যাখাতে আসামীদের জামিন প্রদানে আইনের কোন ব্যত্যয় ঘটেনি বলে তিনি উল্লেখ করেন।
পরে হাইকোর্টের উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগে আসামীদের পক্ষে ফৌজদারী আপীল দায়ের করা হয়। যার নম্বর : ১৬৬১/২০২৩ ইংরেজি।
আসামি মোঃ আবদুর রহমান ও মৌলভী রফিক আহমদ এর পক্ষে আপীল বিভাগে ফৌজদারী আপীল দায়েরকারী সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এ.এম মাহবুব উদ্দিন জানান, প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী’র নেতৃত্বে গঠিত ৪ সদস্যের আপীল বিভাগ গত ২৪ জুলাই ১৬৬১/২০২৩ নম্বর ফৌজদারী আপীলটির দীর্ঘ শুনানী শেষে হাইকোর্টের ২১৮৪/২০২৩ নম্বর রিভিশন মামলাটির রুল খারিজ (ডিসচার্জ) করে চূড়ান্তভাবে আদেশ প্রদান করেন।
আপীল বিভাগের চুড়ান্ত আদেশে আসামি মোঃ আবদুর রহমান ও মৌলভী রফিক আহমদ-কে জামিন দেওয়া হয় এবং কক্সবাজারের চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সন্তুষ্টিক্রমে তাদের জামিননামা সম্পাদন করতে বলা হয়।
প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী’র নেতৃত্বে চূড়ান্তভাবে রুল নিষ্পত্তি (ডিসচার্জ) করে আদেশ প্রদানকারী ৪ সদস্যের আপীল বিভাগের অন্যান্য সদস্যরা হলেন-বিচারপতি এম.এনায়েতুর রহিম, বিচারপতি মো: আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসাইন।
আপীল বিভাগের আদেশ অনুযায়ী আসামি মোঃ আবদুর রহমান ও মৌলভী রফিক আহমদ গত ৮ আগস্ট কক্সবাজারের চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জামিননামা সম্পাদন করে যথারীতি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেছেন বলে জানিয়েছেন, একই আদালতের ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশেক ইলাহী শাহজাহান নুরী।
সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ কর্তৃক গত ২৪ জুলাই হাইকোর্টের জারীকৃত রুল চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি (Discharge) করে আদেশ দেওয়ার পর আবারো কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলকে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. বদরুজ্জামান ও বিচারপতি এস. এম মাসুদ হোসেন দোলনের বেঞ্চে আগামী ১৬ আগস্ট হাজির হতে গত ৮ আগস্ট এক আদেশ দেন।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ কর্তৃক চূড়ান্তভাবে রুল নিষ্পত্তি (Discharge) করে আদেশ দেওয়ার পর আবারো কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজকে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে তলব করার বিষয়টি নিয়ে চরম বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।
আপীল বিভাগে আসামীদের নিয়োজিত আইনজীবী ব্যারিস্টার এ.এম মাহবুব উদ্দিন এ বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর তখন বলেছিলেন, মহামান্য আপীল বিভাগ যেখানে হাইকোর্টের রুল চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি (Discharge) করে আদেশ দেন, সে বিষয়ে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের সন্তুষ্টির কিছুই নেই, এনিয়ে হাইকোর্ট বেঞ্চের আর কিছুই করার থাকেনা। কারণ হাইকোর্ট বিভাগের উর্ধতন আদালত হচ্ছে আপীল বিভাগ। আর আপীল বিভাগের অধস্তন আদালত হচ্ছে হাইকোর্ট বিভাগ। তিনি এবিষয়টি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে মন্তব্য করেছিলেন, ব্যাপারটা স্বাভাবিক নিয়ম ও ন্যায়সংগত মনে হচ্ছেনা।
রোববার (১৩ আগস্ট) প্রদত্ত হাইকোর্ট বিভাগের আদেশ তাঁকে জানানোর পর ব্যারিস্টার এ.এম মাহবুব উদ্দিন বলেন, হাইকোর্ট বিভাগের এ আদেশটাই ন্যায়সঙ্গত ও স্বাভাবিক। অন্যদিকে, আপীল বিভাগে রুল চূড়ান্তভাবে ডিসচার্জ হওয়ার পর গত ৮ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগের দেওয়া আদেশটি ছিল অস্বাভাবিক ও অকার্যকর।
এদিকে, টেকনাফ থানায় শামসুল ইসলাম এর করা ১১৭/২০২৩ নম্বর জিআর মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) এসআই মোনেম শাহরিয়ার চৌধুরী গত ২৮ এপ্রিল আদালতে মামলাটির চার্জশীট দাখিল করেছেন বলে জানিয়েছেন-কক্সবাজারের কোর্ট ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ সাইদুর রহমান। তিনি আরো জানান, চার্জশীটে মামলাটি পেনাল কোডের ১৪৩/৩২৩/৫০৬ ধারায় প্রাথমিকভাবে অভিযোগ আনা হয়েছে।
এবিষয়ে ফৌজদারী আইন বিশেষজ্ঞ একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেন, ১৮৬০ সালের পেনাল কোডের উল্লেখিত ধারার মামলা গ্রাম আদালতেই বিচার্য। সুতরাং একজন সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ এ মামলার উল্লেখিত ধারার ২ জন আসামীর জামিন আবেদন শুনানীক্রমে মঞ্জুর করাটাই ছিলো যুক্তিযুক্ত ও ন্যায়সংগত।
উক্ত প্রবীণ আইনজীবীর মতে, আসামীদ্বয়ের জামিন প্রদানে বিজ্ঞ বিচারক আইনের কোন ব্যত্যয় ঘটাননি। যা হাইকোর্টের প্রদত্ত রুল চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি (ডিসচার্জ) করে আপীল বিভাগ আসামীদের আবার জামিন দেওয়াতে কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজের গত ২৫ এপ্রিল প্রদত্ত জামিন আদেশ সঠিক এবং ন্যায়সংগত বলে প্রমাণিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের জেলা নাজির বেদারুল আলম জানিয়েছেন, কক্সবাজারের সদ্য বিদায়ী সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল এর সরকারি চাকুরীর বয়সসীমা পূর্ণ হতে যাওয়ায় অবসরজনিত কারণে গত ৬ আগস্ট উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁর করা আবেদনের অভিপ্রায় অনুযায়ী তাঁর চাকুরীর মাত্র ২ কার্যদিবস বাকী থাকতে তাঁকে কক্সবাজার থেকে বদলী করে তাঁর চাকুরী আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছে।
আইন ও বিচার বিভাগের সংযুক্ত কর্মকর্তা হিসাবে যাতে তিনি পিআরএল সহ অবসর উত্তর অন্যান্য সকল সরকারি সুযোগ সুবিধা ঢাকা থেকেই ভোগ করতে পারেন। সেজন্য তিনি কক্সবাজারে গত ১০ আগস্ট শেষ কর্মদিবস অতিবাহিত করেন।
দীর্ঘ ৩২ বছরের বিচারিক জীবনের শেষে বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল আজ সোমবার (১৪ আগস্ট) তাঁর সর্বশেষ কর্মদিবসে আইন ও বিচার বিভাগের সংযুক্ত কর্মকর্তা হিসাবে যোগ দিয়ে মঙ্গলবার ১৫ আগস্ট থেকে নিয়মিত অবসর উত্তর ছুটিতে (পিআরএল) যাবেন বলে জেলা নাজির বেদারুল আলম জানিয়েছেন।