অ্যাডভোকেট মো. রায়হান আলী: প্রযুক্তির আমূল উন্নতি সাধনেই আধুনিকায়ন সহজ হয়ে পড়েছে। এই আধুনিকায়নের সবচেয়ে বড় আশির্বাদ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সেবার উন্নয়ন। এই উন্নয়নকে বাস্তবে পরখ করতে প্রযুক্তির সাথে ইন্টারনেট সংযুক্ত করে আমরা নিমিষেই খুব সহজেই সামাজিক যোগাযোগ বা গণমাধ্যমের মাধ্যমে দ্রুতই সংবাদ আদান-প্রদান করতে পারি।
বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো হলো- ফেসবুক, ম্যাজেঞ্জার, হোয়াট্স অ্যাপ, ইমু, ভাইবার, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, গুগোল ইত্যাদি। এসব মাধ্যমের কল্যাণে নিমিষে দেশ-বিদেশের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে যেসব গণমাধ্যমের টাইমলাইন ব্যবহারের সিস্টেম থাকে সেসব টাইমলাইন, নিউজফিড ভরে যায় প্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয় সংবাদ, ছবি ও ঘটনায়। এ সুযোগটি করে দিচ্ছে ইন্টারনেট।
সারা বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৭০ শতাংশ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংযুক্ত রয়েছে। তরুণদের মধ্যে এ হার আরও বেশি, প্রায় ৯০ শতাংশ। বাংলাদেশে যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করে তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ মানুষের রয়েছে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। এ পরিসংখ্যানটা ২০১৮ সালের হলেও বর্তমানে সংখ্যাটা হয়তবা আরো বেড়ে গেছে।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে কম্পিউটার, স্মার্টফোন ও আইফোন ইত্যাদি দ্বারা। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে যে কোনো ব্যক্তি খুব সহজেই তথ্য, উপাত্ত, মতামত, ছবি, ভিডিও, ভিডিও সাক্ষাৎকার ইত্যাদি আদান-প্রদান করতে পারে। এসব হলো আধুনিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রাণ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া থেকে কিছুটা ভিন্ন।
তথ্য-প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে অবগত না থাকায় প্রতিনিয়ত মনের অজান্তেই অনেকে সাইবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এমনকি পর্নোগ্রাফি, সাইবার বুলিং, সহিংস উগ্রবাদ, গুজব, রাজনৈতিক গ্যাং কালচার, জালিয়াতি, চাঁদাবাজি, পাইরেসি, অপপ্রচার, মিথ্যা সংবাদ, আসক্তি এ সবই হচ্ছে তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে। বিশেষ করে যুব সমাজ নেশার মতো আসক্ত হয়ে পড়ছে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারে। আর এ আসক্ততা থেকে জড়িয়ে পড়ছে সাইবার অপরাধে।
অনেকে প্রযুক্তির অপব্যবহার জেনে শুনেই করছে নিজ স্বার্থে কিংবা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে। সাইবার অপরাধ বা কম্পিউটার অপরাধ এমন একটি অপরাধ যা কম্পিউটার এবং কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সাথে সম্পর্কিত। সুতরাং ইন্টারনেট ভিত্তিক অপরাধেই হল সাইবার অপরাধ। এ অপরাধের রাশ টানা কঠিন হয়ে পড়েছে।
ইদানিং ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ইমু, হোয়াট্স অ্যাপের সহজ ব্যবহারের অপব্যবহারে বেড়েই চলছে সাইবার অপরাধ। সবচেয়ে এ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বেশি তরুন-তরুনী, শিক্ষার্থী ও নতুন দম্পতিরা। ঘটনাক্রমে প্রথমে একজন মেয়ের সাথে একজন ছেলের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয় হয় কিংবা পূর্ব পরিচিত। এ সম্পর্কের জেরে উভয়ের মধ্যে চলে বিভিন্ন প্রকার ভার্চুয়াল লেনদেন। তা হতে পারে, টেক্স, অডিও-ভিডিও বার্তা, ছবি কিংবা আবেগে অন্তরঙ্গ কোন ভিডিও ক্লিপ।
এসব আদান-প্রদানের মধ্যে উভয়ের সম্পর্কটা বেশ মধুর চলতে থাকে। কিছু সম্পর্ক বিয়ে পর্যন্ত রুপ নেয় আর বেশিরভাগ সম্পর্কই বিয়ের আলোর মুখ দেখতে পারে না! তখনই শুরু হয় সম্পর্কের টানাপোড়েন। সম্পর্ক চলাকালীন উভয়ের মধ্যে সম্মতিতে কিংবা কোন কৌশলে যদি সেক্সুয়্যাল ইন্টারকোর্স হয় তাহলে পুরো সম্পর্কটা বেশিরভাগেই বিয়ে পর্যন্ত গড়ায় না। আবার এমনটাও হয় সেক্সুয়্যাল ইন্টারকোর্স টাইম আবেগে বা প্রতারণার অংশ হিসেবে ছেলে গোপনে কিংবা মেয়ের সম্মতিতে মোবাইল ক্যামেরায় ভিডিও ধারণ করে রাখে।
পরবর্তীতে ছেলে যখন মেয়েটিকে আবার যৌন কামনা-বাসনার জন্য অফার করে তখন যদি মেয়ে কোন কারনে তাতে অস্বীকৃতি জানায় তখনেই বিপত্তি। ছেলে তখন মেয়েকে হুমকি দিয়ে বলে দেখ তোমার আমার যৌন সম্পর্কের ভিডিও সংরক্ষণ আছে, যদি আমার কথা মতো না চলো তাহলে ফেসবুকে প্রচার কিংবা তোমার আত্মীয়-স্বজনদের ফোনে এসব ভিডিও পাঠাবো ইত্যাদি বলে। আবার এমনটাও ঘটে মেয়ের অন্য কোথায় বিয়ে হয়ে গেছে। তখন ওই ছেলে সংরক্ষণকৃত ভিডিও মেয়ের নতুন স্বামীর কাছে পাঠায় কিংবা পাঠানোর হুমকি দিয়ে সংসার ভাঙার পায়তারা। এসবের মধ্যে অনেকে মেয়ের ছবি এডিট করে ফেক ফেসবুক আইডি খুলে নগ্ন ছবি/ভিডিও বানিয়ে ফেসবুকে প্রচার করে কিংবা মেয়ের নিকটজনদের কাছে পাঠায়। এসব সাইবার অপরাধ।
এমন অপরাধের সংখ্যাটা বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি। বিভিন্ন প্রকারে সাইবার অপরাধ বাড়ছে। এ অপরাধের রাশ টেনে ধরার জন্য সরকার আইন প্রণয়ন করেছেন। সাইবার অপরাধের বিচার করা হত ২০১৭ সাল পর্যন্ত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ দ্বারা। বর্তমানে এ অপরাধের বিচার করা হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ দ্বারা। এ আইনটি প্রনয়নের পর জনমনে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ায় সম্প্রতি মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে আইনটি বাতিল করে সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ করা হবে।
ডিএমপির সাইবার নিরাপত্তা ও ক্রাইম ডিভিশনের প্রাপ্ত তথ্য মতে ২০১৫ সালে দেশব্যাপী সাইবার অপরাধের অভিযোগে মামলা হয়েছিল ছয়শ ৩৮টি, যা পরবর্তী বছরেই অর্থাৎ ২০১৬ সালে উক্ত অভিযোগে মামলা হয়েছিল নয়শ ২৩টি। আবার ২০১৭ সালে এক হাজার ৫৮টি মামলা ও ২০১৮ সালে এক হাজার একশ ৩৬টি এবং ২০১৯ সালে এক হাজার চারশ ৫৬টি মামলা হয়েছিল। এ ছাড়া ২০১৫ সালে দুইশ ৩২টি, ২০১৬ সালে দুইশ ছয়টি, ২০১৭ সালে দুইশ ৮০টি, ২০১৮ সালে তিনশ ৭০টি এবং ২০১৯ সালে পাঁচশ ৪০টি পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা হয়েছিল।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত জুনে জাতীয় সংসদে জানান, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার পর থেকে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে এই আইনে ৭ হাজার ১টি মামলা হয়েছে।
সাইবার অপরাধ সম্পর্কিত মামলাগুলোর বিচার করা হয় দেশের আটটি বিভাগীয় সাইবার ট্রাইব্যুনালে। ট্রাইব্যুনালগুলো হচ্ছে- ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনাল, চট্টগ্রাম সাইবার ট্রাইব্যুনাল, রাজশাহী সাইবার ট্রাইব্যুনাল, খুলনা সাইবার ট্রাইব্যুনাল, বরিশাল সাইবার ট্রাইব্যুনাল, সিলেট সাইবার ট্রাইব্যুনাল, রংপুর সাইবার ট্রাইব্যুনাল ও ময়মনসিংহ সাইবার ট্রাইব্যুনাল।
সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। ইতোমধ্যে দেশে এ সাইবার অপরাধ সংক্রান্তে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন বিভাগ, সংগঠন, এনজিও কাজ করে যাচ্ছে তবে সেটি পর্যাপ্ত নয়। শুধু সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমেই এ অপরাধ দমানোর চিন্তা করা মোটেও সমীচিন নয় বরং এ অপরাধের কুফল সম্পর্কে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের, পাবলিক প্লেসে প্রোজেক্টরের মাধ্যমে জনসাধারণের সচেতনতার প্রচার-প্রসার ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে।
লেখক: আইনজীবী, জজ কোর্ট, খুলনা। Email: advrayhan520@gmail.com