একটি হত্যাকাণ্ড। তবে এ ঘটনায় মামলা হয়েছে দুটি। বিচারও চলছে—দুই আদালতে, দুই জেলায়। মামলা দুটির আসামিও ভিন্ন। অবশ্য এক জেলার মামলার বাদীকে করা হয়েছে অপর জেলার মামলার আসামি।
দুই দশক আগে ২০০৩ সালের মে মাসে জয়পুরহাটের কালাইয়ে এক নারীকে অ্যাসিডে ঝলসে হত্যার ঘটনায় দুই জেলায় দুটি মামলা চলমান রয়েছে। যে দুই জেলায় মামলা চলছে, তার একটি জয়পুরহাট, অপরটি বগুড়া।
হত্যার শিকার শাপলার বাড়ি বগুড়ার সদর থানার নিশিন্দারা কারবালা এলাকায়। এ হত্যার ঘটনায় শাপলার মা ফিরোজা বেগম বগুড়া সদর থানায় মামলা করেন।
এ মামলায় শাপলার ‘কথিত’ স্বামী লেবু মিয়া, লেবু মিয়ার বাবা নাছির উদ্দিনসহ আটজনকে আসামি করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে ২০১০ সালের জুনে বগুড়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ অভিযোগ গঠন করেন।
একই ঘটনায় জয়পুরহাটের কালাই থানায় ৯ প্রতিবেশীকে আসামি করে মামলা করেন লেবু মিয়ার বাবা নাছির উদ্দিন। শাপলার মায়ের করা মামলায় তিনি নিজেও আসামি।
নাছির উদ্দিনের করা মামলার তদন্ত শেষে গত বছরের মে মাসে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
তবে এ ক্ষেত্রে বগুড়ার আদালতে বিচারকাজ চলার তথ্য গোপন করা হয়। ফলে জয়পুরহাটের জেলা দায়রা জজ আদালত এ ঘটনায় ৯ জনের বিরুদ্ধে পৃথক অভিযোগ গঠন করেন।
ফৌজদারি আইনের বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আলাদা দুটি আদালতে বিচার চলমান থাকার কোনো সুযোগ নেই। এ ছাড়া দুই আদালতে ভিন্ন ভিন্ন আসামিদের বিরুদ্ধে বিচারকাজ চললে ভুক্তভোগীর পরিবারের ন্যায়বিচারবঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা আছে।
‘মৃত্যুকালীন জবানবন্দি’র ভিত্তিতে অভিযোগ গঠন
২০০৩ সালের ২ মে জয়পুরহাটের কালাইয়ে শাপলা বেগমকে অ্যাসিডে ঝলসে দেওয়া হয়। পরে ১০ মে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শাপলা মারা যান।
এ ঘটনায় বগুড়া সদর থানায় করা মামলায় শাপলার মা ফিরোজা বেগম অভিযোগ করেন, শাপলাকে বগুড়া থেকে অপহরণ করে জয়পুরহাটের কালাইয়ে নিয়ে যান লেবু মিয়া। পরে লেবুসহ তাঁর পরিবারের সদস্যরা অ্যাসিড দিয়ে শাপলার শরীর ঝলসে দেন।
এ মামলায় বগুড়ার পুলিশ ‘তথ্যগত ভুল’ উল্লেখ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। সেখানে পুলিশ জানায়, শাপলার হত্যার ঘটনায় জয়পুরহাটে একটি মামলার তদন্ত চলছে। তবে আদালত শাপলার ‘মৃত্যুকালীন জবানবন্দি’র উল্লেখ করে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।
উল্লেখ্য, শাপলা মৃত্যুর আগে হাসপাতালে মা ফিরোজা বেগম ও বোন শিল্পী বেগমের কাছে তাঁকে অপহরণ করার পর কীভাবে অ্যাসিড ছুড়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়, সে বর্ণনা দেন। এ বর্ণনাকেই ‘ডায়িং ডিক্লারেশন’ বা মৃত্যুকালীন জবানবন্দি বলা হয়।
বগুড়ার নারী ও শিশু নির্যাতন আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আশিকুর রহমান বলেন, বগুড়ায় মামলায় এক যুগের বেশি সময় আগে আদালত অভিযোগ গঠন করেন। দীর্ঘদিন মামলার বাদীর কোনো খোঁজ ছিল না। তবে সম্প্রতি বাদী আবার আদালতে আসছেন। বগুড়ার মামলার আসামিপক্ষ উচ্চ আদালতে গেছেন বলে জানা গেছে। তবে এখনো কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি।
বিচার চলছে এক যুগ, ‘জানে না’ সিআইডি
বগুড়ার আদালতে অভিযোগ গঠনের ১২ বছর পর জয়পুরহাটের মামলায় সিআইডি আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়। অথচ সিআইডি অভিযোগপত্রে বগুড়ার মামলার বিষয়ে কোনো তথ্য উল্লেখ করেনি।
যদিও সিআইডি শাপলার মা ফিরোজা ও বোন শিল্পীকে জয়পুরহাট নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
এ প্রসঙ্গে শিল্পী বেগম বলেন, বগুড়ার মামলার সাক্ষী তিনি। সিআইডি তাঁকে ও তাঁর মা ফিরোজাকে জয়পুরহাটে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। মৃত্যুর আগে শাপলা তাঁকে ও তাঁর মাকে যা বলেছিলেন, সেসব তথ্য সিআইডিকে দিয়েছেন।
পাশাপাশি বগুড়ার আদালতে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চলছে, সে তথ্যও তাঁরা সিআইডিকে জানিয়েছিলেন। তবে সিআইডি অভিযোগপত্রে এ তথ্য উল্লেখ করেনি। এমনকি শাপলার মা ও বোনকে মামলায় সাক্ষীও করেনি।
জয়পুরহাটের কালাই থানায় করা মামলার সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক কে এম মাসুদ রানা। এ বিষয়ে মাসুদ রানা বলেন, তিনি যতটুকু জানেন, বগুড়ায় আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা আছে। সেখানে হত্যার বিচার চলছে না।
বগুড়ার আদালতে শাপলা হত্যার বিচার চলার বিষয়ে জানতেন না বলে মাসুদ রানা দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি বিষয়টি জানতেন। অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার তিন সপ্তাহ আগে বগুড়ার নারী ও শিশু নির্যাতন আদালতের সরকারি কৌঁসুলি আশিকুর রহমানের মাধ্যমে আদালতে চিঠি দিয়ে এ বিষয়ে নির্দেশনা চান তদন্ত কর্মকর্তা মাসুদ রানা।
তিনি ওই চিঠিতে লেখেন, শাপলা হত্যার ঘটনার বিষয়ে দুটি মামলা দুটি আদালতে চলমান। দুটি মামলার বাদী ভিন্ন, আসামিও ভিন্ন। এ ঘটনায় আদালতের সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা বিশেষ প্রয়োজন।
তবে বগুড়ার আদালতের নির্দেশনা পাওয়ার আগেই মাসুদ রানা জয়পুরহাট আদালতে অভিযোগপত্র দেন। সেই অভিযোগপত্রে শাপলার মায়ের দায়ের করা মামলার কোনো তথ্য উল্লেখ করেননি। ফলে জয়পুরহাট আদালত স্বাভাবিকভাবেই অভিযোগপত্রে নাম আসা আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।
বিষয়টি নিয়ে জয়পুরহাট জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) নৃপেন্দ্রনাথ মণ্ডল রায়ের সঙ্গে কথা হয়। তাঁর ভাষ্য, একটি হত্যাকাণ্ডের বিচার দুই আদালতে হওয়ার সুযোগ নেই। বিষয়টি জয়পুরহাট আদালত জেনেছেন। এখন এ বিষয় শুনানির পরই হয়তো আদালত সিদ্ধান্ত নেবেন, এ মামলার ভবিষ্যৎ কী হবে।
‘আইনত ঠিক হয়নি’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। দুই জেলার দুই আদালতে মামলা চলার বিষয়টি সিআইডির অজানা ছিল। এ ব্যাপারে আদালতের নির্দেশনাও চাওয়া হয়েছিল। এরপরও অন্য আদালতে অভিযোগ গঠনের বিষয়টি গোপন করে অভিযোগপত্র দেওয়া কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
জানতে চাইলে রাজধানীর রাজারবাগে ঢাকা মহানগর পুলিশ একাডেমির খণ্ডকালীন শিক্ষক সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাসির উদ্দিন খান বলেন, প্রথম কথা হচ্ছে একই ঘটনায় একই অপরাধে দুটি মামলায় আলাদা অভিযোগপত্র দেওয়ার সুযোগ নেই। দুটি মামলা একীভূত হয়ে তদন্ত হওয়ার কথা।
তিনি বলেন, দ্বিতীয়ত, মৃত্যুকালীন জবানবন্দির ভিত্তিতে যেখানে একটি আদালতে বিচার চলছে, সেখানে অন্য আরেকটি আদালতে এই ঘটনায় অভিযোগপত্র দেওয়ার সুযোগ নেই। তথ্য গোপন করে যদি একই ঘটনায় অন্য আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয় সেটা, আইনত ঠিক হয়নি।
নাসির উদ্দিন খান আরও বলেন, একই ঘটনায় দুটি আদালতে দুটি অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হলে ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে।
সূত্র: প্রথম আলো