প্রসঙ্গ : আইন পেশার ইতিহাস ও আইনজীবী হওয়ার যোগ্যতা
অ্যাডভোকেট দীপজয় বড়ুয়া

প্রসঙ্গ : Anticipatory bail বা আগাম জামিন

দীপজয় বড়ুয়া: আগাম জামিন হলো এক অস্বাভাবিক বিশেষ প্রতিকার এবং জামিনের সাধারণ আইন হতে ব্যতিক্রম যাহা শুধুমাত্র (Discretion) অস্বাভাবিক ও ব্যতিক্রমি পরিস্থিতিতে আদালতের নিজস্ব বিশেষ ক্ষমতা বুদ্ধিমত্তার সহিত সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে মঞ্জুর করা যেতে পারে। সাধারণত পুলিশি মামলার ক্ষেত্রে গ্রেফতার হওয়ার আগেই আগাম জামিনের আবেদন করা যায়। কিন্তু একবার গ্রেফতার হলে আগাম জামিন পাওয়ার সুযোগ থাকে না। ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে একজন নাগরিক যতক্ষণ পর্যন্ত দোষী প্রমাণিত না হবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী বলার সুযোগ নেই।

সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ের ৩১, ৩২ ও ৩৩ অনুচ্ছেদের বিধান অনেকখানি ১৮৯৮ সালের প্রচলিত ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৮ ধারাটিতে প্রতিফলিত হয়েছে। এই ধারায় আদালতের বিবেচনা সাপেক্ষে হাইকোর্ট ও দায়রা আদালতকে আগাম জামিন মঞ্জুরের ক্ষেত্রে অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যেকোনো নাগরিকই এই ক্ষেত্রে গ্রেফতারের ঝামেলা এড়াতে আদালতের কাছে আত্মসমর্পণপূর্বক আগাম জামিনের প্রার্থনা করতে পারবেন।

যদিও ফৌজদারি কার্যবিধির কোনো জায়গায় জামিন কিংবা আগাম জামিনের সুস্পষ্ট কোনো সংজ্ঞায়ন করা হয়নি। বাংলাদেশে ১৮৯৮ সালের প্রচলিত ফৌজদারি কার্যবিধিতে পঞ্চম অধ্যায় ও দ্বিতীয় তফসিল বিবেচনায় দুই ধরণের জামিনের বিষয়ে বলা হয়েছে। সাধারণ জামিন ও আগাম জামিন। সাধারণ জামিনে নির্ধারিত বিধি অনুযায়ী কোনো নাগরিক আটক হওয়ার পর আদালতে সময়মত হাজির করার শর্তে আইনগত হেফাজত থেকে জামিনদারের নিকট সাময়িক সময়ের জন্য সমর্পণ করা বুঝায়।

আর আগাম জামিন হলো কোনো ব্যক্তি গ্রেফতার হওয়ার পূর্বেই সম্ভাবনা বা অনুমানপূর্বক যদি বুঝতে পারে যে সামাজিকভাবে হেয় বা বিদ্বেষপূর্ণভাবে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তদন্ত চলছে তখন ভবিষ্যৎ গ্রেফতার ঝামেলা বা হয়রানি থেকে নিজেকে বাঁচাতে স্বশরীরে দায়রা আদালতে বা হাইকোর্ট বিভাগে ৪৯৮ ধারার আলোকে স্বেচ্ছায় ও স্বপ্রণোদিত হয়ে আত্মসমর্পণ করাই হলো আগাম জামিন। বিশেষ পরিস্থিতির কারণে আদালত আগাম জামিন মঞ্জুর হয়। তাই আমলযোগ্য অপরাধ ছাড়া অন্যকোনো ক্ষেত্রে আসামিকে গ্রেফতার করা রীতিসিদ্ধ নয়।

আরও পড়ুন: কোটা সংস্কার আন্দোলন : শিক্ষার্থীদের আসামি করে পুলিশের মামলা

4 BLC (AD) 195-তে মিঃ জাস্টিস এটিএম আফজাল (চীফ জাস্টিস) অভিমত পোষণ করেন যে– এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত নাই যে এরূপ আটক পূর্ব বা আগাম জামিনের আবেদন শুধুমাত্র ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ধারা ৪৯৮ এর অধীনে দায়ের করা যেতে পারে, ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের অন্য কোন ধারায় নয়, যখন হাইকোর্ট বিভাগের এবং দায়রা আদালতের উক্ত ধারায় যুগপৎ ক্ষমতা বিদ্যমান আছে। যেখানে যুগপৎ অধিক্ষেত্র বিদ্যমান সেখানে প্রথমে নিম্ন আদালতে আবেদন দায়ের করতে হবে, তবে এটা কোন অপরিবর্তনীয় বিধান নয়। ব্যাপারটি অধিক্ষেত্র সংক্রান্ত বিষয় নয়, বরঞ্চ ইহা যৌক্তিকতা বা উচিৎ- অনুচিৎ, সুবিধা-অসুবিধা এবং প্রচলিত নিয়ম-নীতির ব্যাপার।

আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে বাস্তব চর্চার মাধ্যমে সরাসরি উচ্চতর আদালতের শরণাপন্ন হওয়া প্রায় রেওয়াজে পরিণত হইয়াছে । যদি আগাম জামিনের কোন আবেদন থাকে, তবে তা অত্যন্ত সীমিত (বা স্বল্প)। অধিকন্তু বাস্তব অনুশীলনের কথা বাদ দিলেও ইহা আশার যোগ্য এবং সঠিক যে যেহেতু প্রার্থীত প্রতিকার অস্বাভাবিক ধরনের, তাই এই প্রকারের বিষয়গুলি হাইকোর্ট বিভাগ পর্যায়ে বিবেচনা করা উচিৎ ।প্রত্যাশা করা যায় যে, অস্বাভাবিক প্রতিকার যে কোন প্রকারের চাপমুক্ত ও পরিপক্ক বিবেচনার সহিত গৃহীত হতে হবে দায়রা জজ পর্যায়ে সম্ভব নাও হতে পারে।

গ্রেফতার পূর্ব জামিন সাধারণ আইনের ব্যতিক্রম এবং আদালতকে সব সময় সাদেক আলীর মামলায় মাননীয় বিচারপতি জনাব এস.এ. রহমান প্রদত্ত সাবধান বানী মনে রাখতে হবে। মূল পরিস্থিতি যা আবেদনকারীকে গ্রেফতার পূর্ব জামিনের আদেশের বিশেষ প্রতিকার লাভের যোগ্য করে তা হলো আদালতে দরখাস্তকারী কর্তৃক প্রকাশিত ঘটনা এবং উপাদান সমূহের উপর আদালতের উপলব্ধি, যে আসামীর বিরুদ্ধে গৃহীত বা দায়েরকৃত ফৌজদারী কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে বা চলমান রাখা হয়েছে তা রাজনৈতিক বা অন্যকোন দুরভিসন্ধিমূলক ভাবে ঐ আবেদনকারীকে নাজেহাল করার জন্য, ন্যায় বিচার পাওয়ার উদ্দেশ্যে নয়।

আরও পড়ুন: বিচারক মৌসুমী সাহাকে হাইকোর্টে তলব

অন্য আর একটি মাত্র কারণে দরখাস্তকারীর প্রার্থনা বিবেচনা করা যেতে পারে। যদি স্থানীয় জনগণের মধ্যে হৈ চৈ, উত্তেজনা বা বিক্ষোভ থাকে বা অন্যকোন পরিস্থিতি বিরাজমান থাকা প্রমানিত হয় যার দরুন দরখাস্তকারীর পক্ষে নিম্ন আদালতে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করা সম্ভব নয়। জামিনের আবেদন গ্রহণ করার পূর্বে অবশ্যই দরখাস্তকারীকে শারিরীকভাবে আদালতে উপস্থিত থাকতে হবে এবং যদি আদালত আগাম জামিন মঞ্জুর করেন তাহলে আদালত অবশ্যই শর্ত আরোপ করবেন যে যদি দরখাস্তকারী জামিনের কোন শর্ত ভঙ্গ করেন তাহলে সংশ্লিষ্ট আদালত ইচ্ছা করলে তার জামিন বাতিল করে নিজ জিম্মায় নিতে পারবেন।

66 DLR (AD) 92 Durnity Commission Vs. Dr. Khandaker Mosharraf Hossain- মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, আগাম জামিন অভিযোগপত্র দাখিল উত্তর সময়ে কার্যকর থাকবে না।

15 BLD (AD) 14 Md. Atiqullah Khan Masud Vs. The State and another- মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “অভিযুক্ত দুজনের জামিন বিজ্ঞ আদালত আগেই নাকচ করে দিয়েছেন ও অপরাধ সংশ্লিষ্ট দ্রব্য নষ্ট করার কোন সম্ভাবনা নেই এবং আপিলকারীর পক্ষে জামিনের সুবিধা অপব্যবহার করার কোন সম্ভাবনা নেই । এমন বিবেচনা করে পিটিশনারকে জামিন দেয়া হলো।”

43 DLR (AD) 33 The State Vs. M. A. Malik- মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “ন্যায়বিচার পাবার জন্য নয় এবং দুরভিসন্ধিমূলে কোন ব্যক্তিকে হয়রানী করার জন্য তার বিরুদ্ধে কেউ কোন ফৌজদারী মামলা করলে কিংবা নিম্ন আদালতে তার পক্ষে কোন অজুহাতে উপস্থিত হওয়া সম্ভবপর না হলে কিংবা কোন বিশেষ অবস্থায় বিচারকের স্ব-বিবেচনায় সংগত হলে অভিযুক্তকে আগাম জামিন প্রদান করতে পারেন । দায়রা বিচারক বা হাইকোর্ট বিভাগ এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৮ ধারা অনুসারে অভিযুক্ত দায়রা আদালতে কিংবা হাইকোর্ট বিভাগে আগাম জামিনের আবেদন করতে পারে।”

আরও পড়ুন: হাইকোর্টের রায় প্রকাশ: সরকার চাইলে কোটা সংস্কার করতে পারবে

51 DLR (AD) 242 The State Vs. Abdul Wahab Shah Chowdhury- মামলার সিদ্ধান্তে মাননীয় বিচারপতি লতিফুর রহমানের মতে, (একমত পোষণ করে), “আগাম জামিন অর্থ আমরা গ্রেফতার পূর্ববর্তী জামিন বুঝি। পার্থক্য হচ্ছে গ্রেফতার করার পরে জামিন দেয়া হয়, আর আগাম জামিন দেয়া হয় গ্রেফতারের পূর্বে । অন্য কথায় গ্রেফতার পূর্ববর্তী মুক্তির আদেশের ন্যায় এটি গ্রেফতার পরবর্তী জামিন আদেশের মত নয়।”

আগাম জামিন স্পষ্টতই একটি বিশেষ পদক্ষেপ যেখানে সাধারণতঃ অভিযুক্তব্যক্তিকে জামিনের আবেদন করতে হয় ফৌজদারী আদালত ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয় ক্ষমতা সম্বলিত সর্বনিম্ন ধাপে (অর্থাৎ সর্বনিম্ন আদালতে)। বাস্তবিক পক্ষে ইহাই হলো সংশ্লিষ্ট আইনের বিন্যাস বা পরিকল্পের প্রত্যাশা।

19 BLD (AD) 189 The State Vs. Abdul Wahab Shah Chowdhury মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “আগাম জামিন কোন সাধারণত প্রতিকার নয় এবং এটি জামিন সংক্রান্ত সাধারণ আইনের একটি ব্যতিক্রম । শুধুমাত্র ব্যতিক্রম ক্ষেত্রেই ইচ্ছাধীন ক্ষমতা যথাযথভাবে প্রয়োগ করে আগাম জামিন দেয়া যাবে।”

57 DLR 244 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “এই পর্যায়ে দরখাস্তকারীর আত্মসমর্পণ করার জায়গা না থাকায় এবং পুলিশ তার পিছু লাগায় পুলিশ রিপোর্ট দাখিল করার সীমিত সময় পর্যন্ত তার পূর্বানুমিত জামিন মঞ্জুর করা হলো।”

আরও পড়ুন: শিক্ষার্থীদের জন্য আদালতের দরজা খোলা: প্রধান বিচারপতি

43 DLR 312 Zulfiqar Ali Vutto Vs. The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “আগাম জামিনের আবেদনকারীর বাসায় পুলিশ তাকে গ্রেফতারের উদ্দেশ্যে গিয়েছিল । পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে একটি মামলা হয় এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে এরূপ গ্রেফতারের প্রচেষ্টা । অভিযুক্ত ব্যক্তি জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে একজন প্রার্থী ছিলেন । তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিরা পুলিশের সহায়তায় তাকে বন্দী করে পরাজিত করার উদ্দেশ্যে এরূপ করা হয়েছে। এরূপ পরিস্থিতিতে অযথা হয়রানির শিকার হতে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে আগাম জামিন মঞ্জুর করা হয়।”

কে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করেঃ ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৮ ধারার বিধান মোতাবেক কোন জামিন অযোগ্য মামলায় বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ আগাম জামিন সংক্রান্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন।

সুতরাং বলা যায় যে, আগাম জামিন হলো কোনো ব্যক্তি গ্রেফতার হওয়ার পূর্বেই সম্ভাবনা বা অনুমানপূর্বক যদি বুঝতে পারে যে সামাজিকভাবে হেয় বা বিদ্বেষপূর্ণভাবে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তদন্ত চলছে তখন ভবিষ্যৎ গ্রেফতার ঝামেলা বা হয়রানি থেকে নিজেকে বাঁচাতে স্বশরীরে দায়রা আদালতে বা হাইকোর্ট বিভাগে ৪৯৮ ধারার আলোকে স্বেচ্ছায় ও স্বপ্রণোদিত হয়ে আত্মসমর্পণ করাই হলো আগাম জামিন। বিশেষ পরিস্থিতির কারণে আদালত আগাম জামিন মঞ্জুর হয়।

তথ্যসূত্র: ফৌজদারী কার্যবিধি-জহিরুল হক, ফৌজদারী কার্যবিধি- মুহাম্মদ সাইফুল আলম, ফৌজদারী কার্যবিধির ভাষ্য-গাজী শামসুর রহমান, শতাধিক বছরের ক্রিমিনাল কেস রেফারেন্স-এডভোকেট কামালউদ্দিন, ক্রিমিনাল কেস রেফারেন্স- জীবরুল হাসান,উইকিপিডিয়া, ক্রিমিনাল কেস রেফারেন্সন-জীবরুল হাসান ,Section Wise 100 years Reference on Crpc, Section Wise 100 years Reference on Penal Code- Md. Abul Kalam Azad।

লেখক: আইনজীবী, জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।