মিজানুর রহমান তালুকদার: বিচার চাওয়া এবং বিচার পাওয়া নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। সর্বশেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে একমাত্র বিচারব্যবস্থায় আইন-আদালতের মাধ্যমেই মানুষ তার ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। রাষ্ট্রনায়ক আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের বক্তব্য হলো- ‘The first duty of society is justice.’ মূলত, সমাজ তথা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব হলো, মানুষের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
একটি আধুনিক কল্যাণরাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, সমাজের সব শ্রেনীর নাগরিকের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকারগুলোর নিশ্চয়তা বিধান করা। আর ন্যায়বিচার ও সমতা ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িত। সুবিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই একটি সমতল ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। সমাজে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বিচারব্যবস্থার সহজলভ্য সুষম কাঠামো ও তৃণমূল পর্যায়ে বিকেন্দ্রীকৃত বিচারব্যবস্থা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
১৯৮০ এর দশকে দেশের সব থানা বা উপজেলা পর্যায়ে মাননীয় সহকারী জজের নেতৃত্বে দেওয়ানী ও ফৌজদারী আদালত গঠিত হয়েছিল। ১৯৯১ সালে ক্ষমতার পালাবদল হলে উপজেলা পর্যায়ে স্থাপিত মাননীয় সহকারী জজদের দ্বারা পরিচালিত দেওয়ানী ও ফৌজদারী আদালতগুলো জেলা পর্যায়ে ক্লোজ করা হয়।
উপজেলা পর্যায়ে মাননীয় সহকারী জজ আদালত ১৯৮২ সাল থেকে প্রায় ৭-৮ বছর নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করেন। গ্রামের প্রান্তিক মানুষ তথা বিচারপ্রার্থী নাগরিক ব্যাপকভাবে এ আদালতের সুফল পেতে শুরু করেন। মাননীয় আদালত বাড়ীর নিকটবর্তী হওয়ায় বিচারপ্রার্থী ও অভিযুক্তের হাজিরা বৃদ্ধি পায়। সাক্ষী-সাবুদ হাজির করাও সহজসাধ্য হয়।
উপজেলায় মাননীয় আদালত থাকার কারণে বিশেষ করে প্রান্তিক অঞ্চলের অভিযোগকারী নারীরা অধিক উপকৃত হন। বিশেষত বিবাহবিচ্ছেদে, দেনমোহর ও খোরপোষের মামলাগুলো নিষ্পত্তি সহজ হয়ে যায়। মাননীয় আদালত কাছে থাকায় থানাও সতর্ক থাকতো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে থানা মামলা গ্রহণ না করলে বিচারপ্রার্থী সরাসরি মাননীয় আদালতের শরণাপন্ন হতে পারতেন।
আরও পড়ুন: পূরণ হলো বিচারকদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন, গাড়ি কিনতে পাবেন সুদমুক্ত ঋণ
তাছাড়া উপজেলায় মাননীয় আদালত থাকার কারণে ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মরত গ্রাম আদালত সতর্কতার সঙ্গে তাদের কাছে দায়েরকৃত মামলাগুলো দ্রুততার সঙ্গে নিষ্পত্তি করতেন। উপজেলা পর্যায়ে মাননীয় আদালত, পুলিশ, প্রশাসন ও সালিশ ব্যবস্থার মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষিত হচ্ছিল।
উপজেলা শহর এখন যোগাযোগসহ সবদিক থেকে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত সুন্দর বসবাস উপযোগী এলাকা। সরকারের অন্যান্য বিভাগের অনেক কর্মকর্তা পরিবার-পরিজন নিয়ে উপজেলায় বসবাস করেন। দু’জন মাননীয় সহকারী জজ এখন স্বাচ্ছন্দে উপজেলায় বসবাস করতে পারবেন। দেশে এখন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর শতশত ছাত্র-ছাত্রী আইনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়ে বের হচ্ছেন। তাই উপজেলায় আইনজীবী পেতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
বিদ্যমান আইনে গ্রাম আদালতের যে এখতিয়ার তাতে আনুষ্ঠানিকভাবে এ আদালতে বেশিরভাগ মামলার নিষ্পত্তি সম্ভব হয় না। এগুলো অনানুষ্ঠানিকভাবে গ্রাম আদালতের বাইরে মীমাংসা হয়। অনেক সময় এসব মীমাংসায় প্রভাবশালী পক্ষ দুর্বল পক্ষের ওপর তাদের সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়ে দেয়। তাই বলে গ্রাম আদালতের এখতিয়ার ও ক্ষমতা বাড়াতে হবে এই মত-ও যৌক্তিক নয়।
বর্তমানে উপজেলা পর্যায়ে ৩৫টি সরকারী বিভাগ ও সংস্থা কাজ করে। সেখানে বিচার বিভাগের অনুপস্থিতি দেশের নাগরিকদের মধ্যে বিচার বৈষম্য সৃষ্টি করছে। গ্রামাঞ্চলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি স্থায়ীরূপ পেতে বসেছে।
উপজেলা পর্যায়ে বিচার বিভাগ সম্প্রসারণ করে এ বৈষম্য দূর করতে হবে। আর দেরী না করে উপজেলা পর্যায়ে মাননীয় সিনিয়র সহকারী জজ ও মাননীয় সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রতিষ্ঠা করা উচিত। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে উপজেলা পর্যায়ে মাননীয় আদালতের সম্প্রসারণ এখন সময়ের দাবী।
লেখক: অ্যাডভোকেট, নোয়াখালী জেলা বার এসোসিয়েশন।