ফিরোজ উদ্দিন: ২০২০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০–এর সংশোধিত আইনে ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ও ভুক্তভোগী ব্যক্তির সম্মতি না থাকলেও ডিএনএ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে বাধ্যতামূলক ডিএনএ পরীক্ষার বিধান ও ব্যক্তির অধিকার, ডিএনএ রিপোর্টের সত্যতা, সাক্ষ্য হিসেবে ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্টের মূল্য প্রভৃতি বিষয় বিশ্লেষণের দাবি রাখে। তাই আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর অধীন অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং অপরাধের শিকার ব্যক্তির ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষার পদ্ধতি, প্রয়োগ ও সাক্ষ্যগত মূল্য।
আইনের ৩২ক ধারায় অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং অপরাধের শিকার ব্যক্তির ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষার কথা বলা হয়েছে। সে অর্থে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) হলো কোন জীবন্ত কোষের বংশগতির মৌলিক উপাদান। ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষার মাধ্যমে মানুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্য, আচরণ, চরিত্র ও কার্যকলাপ সম্পর্কে জানা যায়। ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থায় অপরাধ প্রমাণে সহায়ক হিসাবে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) এর ব্যবহার যুগান্তকারী পদক্ষেপ। অনেক ক্ষেত্রে মামলার বিচারিক সিদ্ধান্ত ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) রিপোর্টের উপর নির্ভর করে তবে শুধুমাত্র অভিযুক্ত কিংবা অপরাধের শিকার ব্যক্তির ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষার রিপোর্টের মাধ্যমে অপরাধ প্রমাণ করা সম্ভব না।
অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং অপরাধের শিকার ব্যক্তিরডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষার রিপোর্টের মাধ্যমে অপরাধ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে বিচারিক সিদ্ধান্ত দেওয়া উচিৎ। বিচারে শুধুমাত্র ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষার রিপোর্টের ভিত্তিতে দন্ডাদেশ দেওয়ার নজির খুবই কম এবং ঝুঁকিপূর্ণ। ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষাকারী ব্যক্তিকে সৎ ও দক্ষ হওয়া জরুরী। পরীক্ষকারী ব্যক্তি সৎ ও দক্ষ না হলে ন্যায় বিচার লংঘিত হওয়ার আংশঙ্কা থাকে। পাশাপাশি ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষার রিপোর্টের মাধ্যমে অপরাধের শিকার ব্যক্তি ও অভিযুক্ত ব্যক্তির ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার যেন লঙ্ঘিত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা উচিৎ।
আরও পড়ুন: ডিএনএ রিপোর্ট প্রমাণে সাক্ষ্য দিতে হবে প্রস্তুতকারীকে : হাইকোর্ট
আমাদের দেশে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) নমুনা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি নির্ধারণ, ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) নমুনা ও প্রোফাইলের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) ল্যাবরেটরি স্থাপন, জাতীয় ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) ডাটাবেইজ প্রতিষ্ঠা প্রভৃতির জন্য ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিউ এসিড (ডিএনএ) আইন, ২০১৪ প্রণয়ন করা হয়েছে। এদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০–এর সংশোধিত আইনের ৩২ক ধারায় অভিযুক্ত ব্যক্তি ও অপরাধের শিকার ব্যক্তির মেডিক্যাল পরীক্ষার ছাড়াও ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অর্থ্যাৎ সম্মতি থাকুক বা না থাকুক অবশ্যই তাদের উভয়ের ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষা করাতে হবে।
ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষা জটিল ও সময় সাপেক্ষ হওয়ায় ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষা রিপোর্টের পেতে বিলম্ব হতে পারে। ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিউ এসিড (ডিএনএ) আইন, ২০১৪ এর ২(৬) ধারা বিধানুসারে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য দেহগত পদার্থ [যেমনঃ রক্ত, বীর্য, প্রসাব, পায়খানা, মুখের লালা প্রভৃতি]; কোষকলা নমুনা [যেমনঃ চুল, দাড়ি, মাংস, নখ, চামড়া, হাড় প্রভৃতি]; পরিধেয় বস্ত্র হতে প্রাপ্ত দেহগত পদার্থ [যেমনঃ বীর্য, রক্ত প্রভৃতি]; ঘটনাস্থল হতে প্রাপ্ত দেহগত পদার্থ [যেমনঃ কাপড়, অস্ত্র প্রভৃতি]; এবং বিধি দ্বারা নির্ধারিত অন্য কোন উৎসের নমুনা সংগ্রহ করা যায়।
ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিউ এসিড (ডিএনএ) আইন, ২০১৪ এর ৪ ধারায় বলা হয়েছে, অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা (এসআই পদমর্যাদার নিচে নয়) তদন্তের স্বার্থে ভূক্তভোগী, সন্দেহভাজন, বা অভিযুক্ত ব্যক্তি অথবা অপরাধের সঙ্গে জড়িত অন্যকোন ব্যক্তিকে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) নমুনার প্রদানের অনুরোধ করতে পারে। কিন্তু ভূক্তভোগী, সন্দেহভাজন বা অভিযুক্ত ব্যক্তি শিশু বা মানসিক ভারসাম্যহীন বা শারীরিকভাবে অক্ষম হলে তাদের পিতামাতা বা আইনানুগ অভিভাবক বা তাদের নিয়োজিত আইনজীবীকে নমুনা সংগ্রহের সম্মতি প্রদানের জন্য অনুরোধ করতে পারবেন।
আরও পড়ুন: ধর্ষণের শিকার নারীদের ডিএনএ টেস্ট বাধ্যতামূলক: হাইকোর্ট
আইনের ৬ ধারা অনুসারে তদন্তের প্রয়োজনে নির্ধারিত ফরমে ও পদ্ধতিতে প্রদত্ত সম্মতিতে কমপক্ষে দুইজন সাক্ষীর উপস্থিতি প্রয়োজন। লিখিত সম্মতি ব্যতীত কোন ব্যক্তির নিকট হতে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) নমুনা সংগ্রহ করা যাবে না। তবে ভূক্তভোগী শিশু বা মানসিক ভারসাম্যহীন বা শারীরিকভাবে অক্ষম হলে তাদের পক্ষে পিতামাতা বা আইনানুগ অভিভাবক বা তাদের নিয়োজিত আইনজীবীকে নমুনা সংগ্রহের সম্মতি প্রদান করলে উক্ত ব্যক্তিদের পক্ষের সম্মতি বলে গণ্য হবে। তদন্তের প্রয়োজনে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) নমুনা প্রদানের অনুরোধ করার ৩ (তিন) ঘন্টার মধ্যে অসম্মতি না করলে ৭ ধারা অনুসারে তা অসম্মতি হিসাবে গণ্য হবে এবং বিধি দ্বারা নির্ধারিত ফরমে ও পদ্ধতিতে লিপিব্ধ করবেন। অসম্মতি পর তদন্তের প্রয়োজনে পুলিশ কর্মকর্তা ৮ ধারার বিধান অনুসারে ট্রাইব্যুনালের নিকট ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) নমুনা সংগ্রহের অনুমতির জন্য আবেদন করবেন।
ট্রাইব্যুনাল উভয়পক্ষের বক্তব্য ও দলিলাদি বিবেচনা করে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) নমুনা সংগ্রহের জন্য আদেশ দিতে পারেন। ট্রাইব্যুনালের আদেশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সম্মতি হিসাবে বিবেচিত হবে।মামলায় ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষার রিপোর্ট গুরুত্বপূর্ণ হলেও শতভাগ শুদ্ধ বলা যায় না। এই আইনের ধারা ৩৭ এবং ৩৮ অনুসারে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষার রিপোর্ট ট্রাইব্যুনাল চাইলে গ্রহণ করতে পারবেন এবং রিপোর্ট তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ট্রাইব্যুনালে তলব না করেইডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) রিপোর্টে বর্ণিত মতামতকে উপযুক্ত প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করতে পারেন। ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ৩ ধারা অনুসারে ডিডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) রিপোর্ট সাক্ষ্য হিসাবে স্বীকৃতএবং সাক্ষ্য আইনের ৪৫ ও ৪৫ক ধারা বিশেজ্ঞ মতামতকে প্রাসঙ্গিক চিহ্নিত করে ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হয়ে মতামত প্রদানের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: নারীর প্রতি চলমান সহিংসতা, বিদ্যমান আইন ও একটি পর্যালোচনা
কিন্তু ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিউ এসিড (ডিএনএ) আইন, ২০১৪ এর ৩ ধারায় অন্য আইনের উপর প্রাধন্য থাকায় ট্রাইব্যুনালে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষার রিপোর্ট তৈরিকারী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে উপস্থিত হয়ে মতামত প্রদানের বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের স্বেচ্ছাধীন। ন্যায় বিচারে স্বার্থে ট্রাইব্যুনাল প্রয়োজন মনে করলে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষার রিপোর্টসহতৈরিকারীসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে হাজির হওয়ার আদেশ দিতে পারেন। ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষা ও জটিল ও সময় সাপেক্ষ হওয়ার কারণে পরীক্ষা রিপোর্ট তৈরিকারীসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে দক্ষতা হওয়ার সঙ্গে সৎ হওয়া অবশ্যক। অদক্ষ ও অসৎ ব্যক্তির তৈরি রিপোর্টের ভিত্তিতে দন্ড দিলে ন্যায় বিচার লংঘিত হয়। ফলে শুধুমাত্র ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষার ভিত্তিতে দন্ড দেওয়া যথাযথ নয়। সুতরাং বিচার প্রক্রিয়া ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষার রিপোর্ট সহায়ক প্রমাণ হলেও একমাত্র প্রমাণ নয়।
লেখক: ফিরোজ উদ্দিন; লেজিসলেটিভ এ্যাসিস্ট্যান্ট, আইন প্রণয়ন শাখা-১, জাতীয় সংসদ সচিবালয়। ই-মেইল: firojlawru@gmail.com