মাসুদুর রহমান : ২০২৫ সালের সংশোধিত আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, অনুযায়ী বাংলাদেশে এখন কিছু নির্দিষ্ট ধরণের মামলা দায়েরের আগে বাধ্যতামূলকভাবে মধ্যস্থতা করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পারিবারিক বিরোধ (যেমন তালাক, ভরণপোষণ, সন্তানের অভিভাবকত্ব), কিছু দেওয়ানী মামলা, যৌতুকের মামলা (ধারা ৩ ও ৪), নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(গ) ধারা এবং পাঁচ লক্ষ টাকার কম মূল্যের চেক ডিজঅনার মামলা।
সরকারের যুক্তি হলো—দেশের বিচার ব্যবস্থায় মামলার অতিরিক্ত চাপ কমানো, দ্রুত সমাধান নিশ্চিত করা, এবং আইনগত সহায়তা সেবাকে আরো কার্যকর করা। জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা (NLASO)-র মতে, মধ্যস্থতায় প্রায় ৯০% বিরোধ সমাধান সম্ভব, যেখানে আদালতের মাধ্যমে একটি মামলার নিষ্পত্তিতে কয়েক বছর সময় লাগে। এই পরিবর্তনের মাধ্যমে আইনগত সহায়তা সহজ, সাশ্রয়ী ও জনবান্ধব হবে বলে সরকার আশা করে।
“বিচার”(Justice) আর “মধ্যস্থতা” (Mediation) – দুটি শব্দ, দুটি ভিন্ন দর্শন। একটি হলো রাষ্ট্রের মাধ্যমে প্রাপ্য অধিকারের স্বীকৃতি, অন্যটি হলো পক্ষগুলোর সমঝোতা। বাংলাদেশে ফৌজদারি মামলায় বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতার (Compulsory Mediation) প্রবর্তন ন্যায়বিচারের মৌলিক ধারণাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেছে কিনা? এটি কি ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথ সুগম করছে, নাকি ক্ষমতাবানদের জন্য দায়মুক্তির (Impunity) নতুন দরজা খুলে দিচ্ছে?
মধ্যস্থতার পক্ষে যুক্তি ও সুবিধাসমূহ
বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা যা বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কারণ, দেশে বর্তমানে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় ৪৩ লাখ। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশই পারিবারিক, চেক ডিজঅনার ও দাম্পত্য বিরোধ সম্পর্কিত—এই আইনের মাধ্যমে এসব আপোষযোগ্য মামলায় দীর্ঘসূত্রতা এড়িয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব হবে, যা আদালতের উপর মামলার বোঝা কমিয়ে Alternative Dispute Resolution (ADR) প্রক্রিয়াকে সাংবিধানিক পর্যায়ে সুসংহত করবে; তদ্ব্যতীত, বিচারব্যবস্থায় ব্যয়, সময় ও মানসিক চাপ কমানো একটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, যা জাতিসংঘের Goal 16 of the SDGs – “Access to Justice for All” – এরও অংশ এবং এই ধরনের বাধ্যতামূলক মিডিয়েশন সেই লক্ষ্য অর্জনে কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে; বাস্তবে BLAST, Ain o Salish Kendra (ASK), ও BRAC-এর ADR প্রোগ্রামগুলোতে দেখা গেছে—মধ্যস্থতার মাধ্যমে প্রায় ৭০–৮০% পারিবারিক মামলা শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি সম্ভব হয়েছে (BLAST Annual Report 2023);
এছাড়া ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইনসহ অনেক দক্ষিণ এশীয় দেশেও বাধ্যতামূলক মিডিয়েশনের ব্যবহার বেড়েছে—বিশেষত পারিবারিক ও বাণিজ্যিক বিরোধে; বাংলাদেশের মতো একটি সীমিত বিচারিক অবকাঠামো ও বিচারকের স্বল্পতায় জর্জরিত দেশে, যেখানে একজন ম্যাজিস্ট্রেট বা জজকে প্রতিদিন গড়ে ৬০–৭০টি কেস শুনতে হয় (Law Commission Report, 2022), সেখানে আপোষযোগ্য মামলাগুলো প্রাথমিকভাবে মিডিয়েশন পর্যায়ে পরিচালিত হলে কেবল মামলার জটই কমবে না, বরং বিচারপ্রার্থীরা স্বল্প সময়ে উপযুক্ত সমাধান পাবেন এবং যেহেতু এই আইনে বলা হয়েছে, ব্যর্থ মধ্যস্থতার পর যে কেউ আদালতে যেতে পারবেন, তাই এটি বিচারপ্রাপ্তির অধিকারকে খর্ব না করে বরং এক ধাপে আরামদায়ক সমাধানের সুযোগ তৈরি করে দেয়। বাধ্যতামূলক এই ADR পদক্ষেপটি ন্যায়বিচারকে বিলম্ব নয় বরং সহজ, সাশ্রয়ী ও সংবেদনশীল করে তোলে, যা বাংলাদেশের বিচারপ্রার্থীদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণের এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে বলে বর্তমান সরকার মনে করে।
নতুন আইনের বাস্তবতা
বাস্তবতা, আইনত বিশ্লেষণ এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই বাধ্যবাধকতা ন্যায়বিচারের মূল দর্শনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
প্রথমত, সংবিধানের ২৭ ও ৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রতিটি নাগরিক আদালতের আশ্রয় গ্রহণের অধিকার রাখে, যা এই আইনের ফলে শর্তসাপেক্ষ হয়ে পড়ে। একজন নাগরিক যদি একটি মামলা দায়ের করতে চান এবং তাকে বলা হয়, “তুমি আগে আপোষের চেষ্টা করো,” তা হলে সেটি আসলে আদালতে প্রবেশাধিকারেই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
দ্বিতীয়ত, এই আইন বিশেষভাবে ক্ষতিকর হয়ে উঠবে নারী ও শিশুদের জন্য—বিশেষ করে যৌতুক বা নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলায়। এসব ক্ষেত্রে বাদী প্রায়শই একজন নির্যাতিতা নারী, যিনি দীর্ঘ সময় ধরে তার স্বামীর, শ্বশুরবাড়ির বা আত্মীয়স্বজনের দ্বারা মানসিক বা শারীরিকভাবে নিপীড়িত হয়ে থাকেন। যখন তিনি সাহস করে আইনের আশ্রয় নিতে চান, তখন তাকে বাধ্য করা হচ্ছে সেই অভিযুক্তদের সঙ্গেই মধ্যস্থতায় বসতে, যেখানে তারা তাকে আবার ভয় দেখাতে পারে, সামাজিক চাপে ফেলতে পারে বা তাকে আরেক দফা মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করতে পারে।
তৃতীয়ত, প্রতিটি জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে মাত্র একজন লিগ্যাল এইড অফিসার রয়েছেন, যিনি সেই জেলার হাজার হাজার মানুষকে সেবা দেন এবং এখন তার ওপর অর্পণ করা হচ্ছে সব বাধ্যতামূলক মিডিয়েশন পরিচালনার দায়িত্ব। এটি বাস্তবতা বিবর্জিত একটি পরিকল্পনা। একজন লিগ্যাল এইড অফিসারের পক্ষে প্রতিদিন ৩০-৫০টি অভিযোগ গ্রহণ, আবেদন যাচাই, কাগজপত্র তৈরি, আদালতে প্রতিনিধি পাঠানো এবং মধ্যস্থতার সভা পরিচালনা করা—এই সব কাজ একযোগে করা শারীরিক, মানসিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অসম্ভব।
চতুর্থত, চেকের মামলার অভিযুক্তরা এই বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা ব্যবস্থাকে “সময় কেনার কৌশল” হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ, একাধিক চেক ডিজঅনার মামলায় দেখা গেছে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা আপোষ করবে বলে একের পর এক মধ্যস্থতার তারিখে অনুপস্থিত থেকে মামলার প্রক্রিয়া দীর্ঘ করেন এবং প্রমাণ নষ্ট করেন, যার ফলে বাদী হতাশ হয়ে পড়ে।
সপ্তমত, এই আইনের ফলে আইনজীবীদের ভূমিকা দুর্বল হয়, কারণ মধ্যস্থতার সময়ে অনেক সময় বাদী পক্ষ আইনজীবী নিতে পারেন না বা পান না, ফলে আইনি সহায়তা ছাড়াই একজন নিরীহ মানুষ মিডিয়েটরের মুখোমুখি হয়ে পড়েন—যেখানে তিনি জানেন না, কোনটা তার অধিকার, কোনটা অন্যায়, আর কোন সিদ্ধান্তে তিনি ফেঁসে যেতে পারেন।
অষ্টমত, মিডিয়েশন প্রক্রিয়ার কোনো পর্যবেক্ষণ বা স্বচ্ছতা নেই। একবার মিডিয়েটর যেটা বলে, সেটাই “আপোষ”, কিন্তু সেটা কার স্বার্থে হচ্ছে, সেটা আর জানার উপায় থাকে না। কোনো অভিযোগের ক্ষেত্রে মিডিয়েটরের জবাবদিহি থাকে না, ফলে ভুল সিদ্ধান্ত হলেও তা সংশোধনের কোনো পথ নেই।
এই সব যুক্তি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়—২০২৫ সালের এই বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা ধারা ন্যায়বিচারের মূল দর্শনের বিপরীতমুখী। এটি হয়তো মামলা কমাবে, কিন্তু ন্যায়বিচার নয়; এটি হয়তো সংখ্যাগত পরিসংখ্যানকে ভালো দেখাবে, কিন্তু মানুষের জীবনে নিরাপত্তা, মর্যাদা, ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভয়ংকর ব্যর্থ হবে। তাই এই ধারা হয় সম্পূর্ণভাবে ঐচ্ছিক করতে হবে, নয়তো নারী ও শিশু নির্যাতনের মতো মামলায় এর প্রয়োগ নিষিদ্ধ করতে হবে। মধ্যস্থতা একটি বিকল্প হতে পারে, কিন্তু বিচারপ্রার্থীর অধিকার ও স্বাধীনতার বিকল্প নয়।
উপসংহারে বলা যায়, বিচার কি আর মধ্যস্থতার গল্প? প্রশ্নটির উত্তর স্পষ্ট: না। বিচার আর মধ্যস্থতার গল্প এক নয়। বিচার হল একটি মৌলিক অধিকার, রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং সমাজে ন্যায় ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার ভিত্তি। মধ্যস্থতা একটি দরকারি টুল হতে পারে, কিন্তু শুধুমাত্র তখনই যখন তা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়, ক্ষমতার সমতায় এবং যেখানে প্রকৃত অপরাধের বিষয়টি উপেক্ষিত না হয় – যা মূলত দেওয়ানি বিরোধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফৌজদারি মামলায়, বিশেষ করে নারী, শিশু ও দুর্বল জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অপরাধের ক্ষেত্রে, বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা প্রকৃতপক্ষে দায়মুক্তির (Impunity) আরেকটি পথ প্রশস্ত করছে। এটি ক্ষমতাবানকে রক্ষা করে, দুর্বলকে আরও দুর্বল করে এবং আইনের শাসনকে ক্ষয়িষ্ণু করে তোলে। বিচার ব্যবস্থার চাপ কমানোর নামে ন্যায়বিচারকে বলি দেওয়া কোনো সমাধান হতে পারে না। প্রকৃত সমাধান নিহিত আছে বিচার বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধি, দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিতকরণ, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং একটি সংবেদনশীল ও জবাবদিহি আইনি কাঠামো গড়ে তোলার মধ্যে।
লেখক : মাসুদুর রহমান; আইনজীবী , বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ই-মেইল : masud.law22@gmail.com